এরকম সময় কমলার ভারি মায়া লাগে ওকে দেখতে। তাই প্রায়ই অন্য প্রসঙ্গ তুলে ঠাণ্ডা করে। আজও হঠাৎ মুচকি হেসে বলে, তাই কি শুধু পেটেরই জ্বালা ননীদা? পেটের ওপরতলায় যার বাস,–সেই মনের? সেখানেই কি জ্বালা কম! সেখানেও তো খিদে তেষ্টা! সেখানেও তো দিনরাত রাবণের চিতা!
ননী অপলক নেত্রে একবার কমলার হাসি-ছিটকানো মুখটা দেখে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সবেগে বলে, তোকে যে আবার ভগবান কী দিয়ে গড়েছে তাই ভাবি। এততেও হাসি আয়ে তোর?
আসবে না মানে? বল কি ননীদা? হাসির সালসাতেই তো জীবয়ে আছি এখনো। যেদিন হাসি থাকবে না, সেদিন কমলিও থাকবে না।…ও কি, চলে যাচ্ছ যে?
চলে যাব না তো কি থাকতে দিবি? তার বেলায় তো খিঁচিয়ে ওঠে ননীমাধব।
কমলা চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে চুপচাপ।
অপ্রতিভ ননী মাথা হেঁট করে আবেগরুদ্ধ স্বরে বলে, আর পারছি না, বুঝলি কমলি! এক এক সময় মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। নিত্যি নিত্যি মিথ্যে সিঁদুর পরেই মরছিস, সত্যি সিঁদুর আর দিতে পারলাম না তোকে।
দিন একদিন আসবেই ননীদা। ভগবানের রাজ্যে—
ফের ভগবান! ধমকে ওঠে ননী।
কমলা হেসে ফেলে বলে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় ননীদা। চিরকালের অব্যেস তো! তবুও বলি, ভগবান যে একেবারে নেই তাই বা বলা যায় কী করে? এই ধর না কেন, তুমি যদি এই ফন্দিটি আবিষ্কার না করতে, আজ আমাদের কী দুর্দশা হত বলো তো? মাসি কি তাহলে আমাকে ভাল থাকতে দিত? মেরে হাত-পা বেঁধেও হঠাৎ কেঁদে ফেলে কমলি।
ননী বিমূঢ়ভাবে একটু তাকিয়ে বলে, কান্নাটান্না রাখ কমলি। কান্না আমি বরদাস্ত করতে পারিনে। শোন, উঠে পড়ে লেগে কাজের চেষ্টা আমি করছি। তোদের ভগবান যদি নেহাৎ শয়তান না হয়, একটাও কি লেগে যাবে না? তারপর-ননীর চোখদুটো আবেগে কোমল হয়ে আসে। খাটো ধুতি আর হাফশার্ট-পরা নিতান্ত গ্রাম্য-চেহারার ননীর শ্যামলা মুখেও যেন একটা দিব্য আলো ফুটে ওঠে।
কমলা ব্যাকুলভাবে ওর একটা হাত চেপে ধরে বলে, তাই কর ননীদা, তাই কর। এভাবে লোক ঠকিয়ে বেড়াতে আর ভাল লাগে না।
ননী এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওর হাতটা তুলে একবার নিজের গালে বুলিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে সস্নেহ কৌতুকে বলে, কেন, তুই তো বলিস তোর খুব মজা লাগে!
সে প্রথম প্রথম লাগত। মনে হত লোকগুলো কী ভীতু! এখন ঘেন্না ধরে গেছে। মিছিমিছি মাথায় খানিক সিঁদুর লেপে যাকে তাকে গিয়ে ধরা তুমি আমায় নষ্ট করেছ, তুমি আমায় বিয়ে করে রেখে পালিয়ে গিয়েছ, একি কম ঘেন্নার কথা?
ননী আর একবার অপলক চোখে কমলার পরম সুশ্রী মুখখানার দিকে তাকিয়ে বলে, দেখ কমলি, তুই ওই কেষ্টমোহিনীর সত্যিকার বোনঝি নয় বলেই এসব তোর কাছে ঘেন্নার বস্তু। তোর দেহে যে ভদ্রলোকের রক্ত। যেটুকু পারছিস সে শুধু অন্নঋণে। কিন্তু মাসির হুকুম শুনতে হলে আরও কত লজ্জার হত বল!
শুনতাম আমি! ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়ায় কমলি। দাঁড়িয়ে বলে, পৃথিবীতে মরবার কোন উপায় নেই?
এই–এই জন্যেই তোকে আমার এত ভক্তি হয় কমলি। এখন শুনলে হাসবি হয়তো, কিন্তু আমিও একসময় বামুনের ঘরের ছেলে ছিলাম রে। নবছরে পৈতে হয়েছিল আমার, কানে এখনো বিধ আছে। পেটের জ্বালায় এখন আর জাত নেই।
না থাকে নেই! আপদ গেছে! হেসে ওঠে কমলি।
এবার ননীও প্রসন্ন হাসি হাসে। এমনি মেঘরৌদ্রের খেলাতেই বেঁচে আছে ওরা। ছবিখানা উপুড় করে রাখ কমলি, ওটাকে দেখছি আর গায়ে বিষ ছড়াচ্ছে আমার!
আহা মরে যাই, নিজেরই তো কীর্তি! কিন্তু কই ননীদা, তুমি একদিন তোমার সেই ডার্করুম না কোথায় যেন নিয়ে গেলে না তো আমায়? বলেছিলে যে, সেখানে নিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দেবে, কী করে দুজায়গায় ভোলা আলাদা ছবি এক করে বেমালুম পাশাপাশি ফটো করে দিতে পারো!
ডার্করুম তো আমারই ঘর রে কমলি। দরজা-জানলায় তেরপলের পর্দা লাগিয়ে অন্ধকার করে নিই। তোকে সেখানে? একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে ননী, ইচ্ছে তো খুব করে, কিন্তু ভরসা হয় না।
ভরসা হয় না! কেন গো ননীদা? লোকনিন্দের ভয় বুঝি? কেউ কিছু বলকে?
দূর, লোকের ভারি তোয়াক্কা রাখি আমি! ভয় যে আমার নিজেকেই।
ধেৎ!
ধেৎ মানে?…আমি একটা রক্তমাংসের মানুষ নই? পুরুষমানুষ?
তবু তুমি যে খুব ভাল মানুষ ননদা, মহৎ মানুষ।
ভারি যে লম্বা লম্বা কথা শিখেছিস! মহৎ বৃহৎ–বাসরে বাস!
ননী হেসে ঘরের আবহাওয়া হালকা করে ফেলে,-দেখবি চল, মাসি এখন কী কী বিশেষণ দিচ্ছে আমাকে-মুখপোড়া, লক্ষ্মীছাড়া, হতভাগা, উনুনমুখো!
সম্মিলিত হাসির রোলে ঘর মুখর হয়ে ওঠে।
.
আর ওদিকে কেষ্টমোহিনী রাগে ফুলতে থাকে।
ননী তাদের অনেক উপকার করে সত্যি, তাদের লোক-ঠকানো ব্যবসার সহায়তাও করে ঢের। কিন্তু তাতে কি? তাতে কেষ্টমোহিনীর লাভটা কোথায়? ওই ননী মুখপোড়া আসরে এসে না দাঁড়ালে হয়তো বা এতদিনে কমলিকে টলানো যেত। তাহলে তো পায়ের ওপর পা রেখে…এমন উঞ্ছবৃত্তি করে বেড়াতে হত?…কিছু না হোক, থিয়েটারটা? কোম্পানির লোক এসে কত সাধ্যসাধনা করেছে, এখনো দেখা হলে অনুযোগ করে। মেয়ে একেবারে কাঠকবুল! কবে ননী লক্ষ্মীছাড়ার চাকরি হবে–তবে ওঁকে বিয়ে করে রানী করে দেবে, সেই পিত্যেসে বসে আছেন! আরে বাবা, এই যা করে বেড়াচ্ছিস, এও তো থিয়েটার! পাবলিক স্টেজে করলেই যত দোষ!..কত আশা করে তিন-তিনশ টাকা দিয়ে মেয়ে-ধরাদের কাছে কিনেছিলাম হারামজাদীকে! …অমন মুখ, অমন গড়ন, অমন গাওয়া ঘিয়ের মতন রং–সব বরবাদ! ছি ছি!