ননী হো হো করে হেসে ওঠে, হাসালে মাসি, তোমারও হাত-পা কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে?
না, আমার বুক পাথর দিয়ে তৈরি! বলে কেষ্টমোহিনী অপ্রসন্ন মুখে ঘরে ঢুকে যায় টাকা আনতে।
ননী সব বিষয়ে সাহায্য করে সত্যি, কিন্তু এই এক মস্ত দোষ ননীর, ফি হাত ভাগ চায়। আরে বাবা, তোকেই যদি অর্ধেক দিয়ে দেবো তো দুদুটো মানুষের চলে কিসে? তাই কি থিয়েটারে ঢোকাতেই রাজী করানো গেল লক্ষ্মীছাড়া নির্বুদ্ধি মেয়েটাকে? কিছু করবেন না উনি! ভদ্দর থাকবেন।
তবু ননী যাই এই এক বুদ্ধি আবিষ্কার করেছে, অপমানের ভয় দেখিয়ে মোচড় দিয়ে আদায়, তাই যাহোক করে চলছে। কিন্তু ওই দোষ ননীর, খালি টাকা টাকা!
.
মোটে পনেরো? ননী বেজার মুখে বলে।
কেষ্টমোহিনী আরও বেজার মুখে বলে, তবে সব টাকাই নিয়ে যা! আমরা হরিমটর করি!
অপ্রতিভ হয় ননী। টাকাটা পকেটে পুরে উদাসভাবে বলে, হতচ্ছাড়া ননীরও যে হরিমটরের অবস্থা মাসি! নইলে কি তোমাদের উপায়ে ভাগ বসাতে আসি! এক এক সময় মনে হয়, দূর ছাই, এসব ছেড়েছুঁড়ে ভেগে পড়ি!
সে আমারও করে। বলে উঠে যায় কেষ্টমোহিনী।
ননী কিন্তু টাকা নিয়েই চলে যায় না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে টুক করে উঠোন পার হয়ে ওদিকের ছোট্ট ঘরটায় ঢুকে পড়ে। সে ঘরে একখানা সরু চৌকির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কী একখানা ছবি দেখছিল কমলি ওরফে অরুণা, ওরফে আরও অনেক কিছু। ননীর পায়ের শব্দে ঘাড় ফিরিয়েই চমকে উঠে তাড়াতাড়ি সেখানা উল্টে রেখে উঠে বসল।
ননী চৌকির একপাশে বসে পড়ে সন্দেহের সুরে বলে, ছবিখানা তাড়াতাড়ি চাপলি যে?
ছবি! কোন ছবি? ওঃ–এইটা, ফটোটা? কমলা যেন হঠাৎ ভারি অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তারপরই কী ভেবে হেসে উঠে বলে, চাপলাম পাছে তোমার অহঙ্কার বেড়ে যায়।
আমার অহঙ্কার!
হ্যাঁ গো মশাই। বিভোর হয়ে পড়ে পড়ে দেখছিলাম তোমার ফটোর কায়দা। সত্যি, অবাক হয়ে যাই ননীদা, কী করে কর? কোথায় আমি আর কোথায় এই লোকটা! অথচ এমন বেমালুম মিলিয়ে দিয়েছ, যেন সত্যি ওর সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। এতে আবার আমাকে ফুলের মালা ফুলের মুকুট পরিয়ে সং সাজিয়েছ বলেই আরও হাসি পাচ্ছে।
সং! ননী হেসে উঠে বলে, কই, দেখি আর একবার সংটা কী রকম!
ছোট সাইজের বাঁধানো ফটোখানা এগিয়ে ধরে কমলা। দিয়ে যেন নিতান্ত নিস্পৃহভাবে তাকিয়ে থাকে ননীর দিকে।
.
ননী নিষ্পলক নেত্রে কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, কতবারই এরকম কায়দা কৌশল করলাম, কিন্তু এই ছবিখানা করে ইস্তক বুকটা যেন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে।
ওমা সে কি! কমলা একটু বেশি মাত্রাতেই হেসে ওঠে, ফাঁকা ফাঁকা কি গো? বরং বল যে বুকটা ভরাট হয়ে উঠেছে! এইটাই তো সব থেকে ভাল হয়েছে। দিন দিন তুমি বেশি বাহাদুর হয়ে উঠেছ ননীদা!
দূর, ভাল লাগে না। ননী ছবিটা ঠেলে রেখে বলে, ওই লোকটার পাশে তোর ওই কনে সাজা ছবিটা দেখলেই প্রাণটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
কমলা আরও প্রগর্ভ হাসি হাসতে থাকে। অনেকক্ষণ হেসে বলে, এক নম্বর বুকটা ফাঁকা ফাঁকা, দুনম্বর প্রাণটায় মোচড়। লক্ষণ তো ভাল নয় ননীদা। কী হল তোমার?
ননী নিঃশ্বাস ফেলে বলে, নাঃ, হবে আর কী! ছবিটা দেখছি আর মনে হচ্ছে ওর পাশেই ঠিক মানিয়েছে তোকে।
কমলা ফের হি হি করে হাসে। হেসে হেসে মাথা দুলিয়ে বলে, ঠিক যেমন মানায় রাজপুত্রের পাশে ঘুঁটেওয়ালীকে।…সে যা দেখে এলাম ননীদা, মনে হল স্রেফ রাজপুত্ৰই। তুমি তো দোর থেকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে এলে। আমার এদিকে বাড়ি ঢুকতে পা কাঁপছে। এর আগে এতবড় বাড়িতে কখনো যাইনি বাপু। ভারি ভয় করছিল।
ননী উদাসভাবে বলে, ভয় আমারই কি না করছিল! অথই জলের মুখে, জ্বলন্ত আগুনের মুখে ঠেলে দিই তোকে শুধু দুটো টাকার জন্যেই তো? এই যদি আজ আমার অবস্থা ভাল হত—
চুপ করে যায় ননী। বোধ করি গলাটা ধরে যায় বলেই।
কমলা এবার ম্লান হয়ে যায়। ম্লান মুখেই বলে, সত্যি ননীদা, তাই ভাবি কেন এমন হয়! এই ওদের বাড়ি গিয়েই মনে হচ্ছিল, ওদের যত টাকা তার একশ ভাগের একভাগও যদি তোমার থাকত ননীদা!
একশ ভাগের? ননী ঝাজের সঙ্গে বলে ওঠে, তোর তাহলে কোন ধারণাই নেই। লক্ষ লক্ষ ভাগের এক ভাগ বল বরং। আমাদের কি কোন ভাগই আছে ছাই! এই পৃথিবীতে কোন কিছু ভাগ নেই আমাদের, এই হচ্ছে ভগবানের বিচার, বুঝলি কমলি?
কমলাও একই রকম ঝাজালো সুরে বলে, যা বলেছ ননীদা। অথচ এই ভগবানের কাছেই নাকি মানুষের পাপপুণ্যির বিচার! চুরি করলে পাপ, লোক ঠকালে পাপ, মিছে কথা বললে পাপ, নিজেকে নিজে খারাপ করলেও পাপ–কিন্তু ভগবানের পাপের বিচার করবার জন্যে কোথাও . কেউ থাকলে যে কী দুর্দশা হত লোকটার, তাই ভাবি!
ননী গম্ভীরভাবে বলে, ভগবানের পাপের? গরম তেলে ফেলে ভাজলেও ভগবানের উচিত শাস্তি হয় না, বুঝলি? ভেবে দেখ দিকি, মানুষগুলোকে গড়ল, তাদের মধ্যে লোভ হিংসে রাগ অভিমান ঠেসে ঠেসে ভরে দিল, অথচ উপদেশ দিল কী–তোরা দেবতা হ। …পাগল না মাতাল? তারপর দেখ, মানুষ গড়েছিস গড়, তাদের পেট গড়বার কী দরকার ছিল তোর? এমন পেট গড়েছে, সে পেটে দিনরাত রাবণের চিতা জ্বলছে! একবেলা তাকে ভুলে থাকবার জো নেই! ছি ছি!
ননী প্রায়ই এ ধরনের কথা বলে। আর এসময় ভারি উত্তেজিত দেখায়।