ঘরে তুলতে দিচ্ছে কে!
খুব হেসেছিল তখন কেষ্টমোহিনী, তুই মাগী বৌ নাতি ঘরে তুললে কেষ্টমোহিনী মা লক্ষ্মীকে ঘরে তুলবে কোন পথ দিয়ে? ওই ফরসা টুকটুকে ছেলেটাই হল কেষ্টমোহিনীর লক্ষ্মীর সরা। ভাগ্যিস যাই নয়না ছুঁড়ি ছেলেটাকে ভাড়া খাটায়! এই এতটুকুন থেকে কত জায়গায় গিয়ে কত রোজগার করল ছোঁড়া!
পেয়ারাবাগানের সেই দাসেদের বাড়ি?
ওঃ, তাদের কাগিন্নীতে তো লাঠালাঠিই বেধে গেল। তবু তো বুড়ো কত্তা অবিশ্যি ভীষ্মদেব তিনি নন,–মদো মাতাল, আরও অনেক গুণের গুণনিধি। কেষ্টমোহিনী নিজেই তার গুণের সাক্ষী। সেই ভরসাতেই বুকের পাটা শক্ত করে কমলিকে নিয়ে আর নয়নার ওই ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে দাসগিন্নীর কাছে কেঁদে পড়ে পাঁচশোখানি টাকা আদায় করে এসেছে কেষ্টমোহিনী।
অবিশ্যি শুধু কান্নায় হয়নি, ভয় দেখাতে হয়েছে। লোক-জানাজানি করে দেবার ভয়। দাসগিন্নী সহজেই বিশ্বাস করেছিল, কর্তার রীতি-চরিত্তির তো বরাবরই জানতো। চুপি চুপি বলেছিল কেষ্টমোহিনীর কাছে, ওই বুড়ো বদমাশের হাতে দড়ি পড়লেই আমি বাঁচতাম বাছা, উচিত শাস্তি হতো। তোমার মামলার খরচা আমিই জোগাতাম।নাতনীর বয়সী একটা পুঁটকে ছুঁড়ির সঙ্গে কেলেঙ্কারি করার মজাটা টের পেত! কিন্তু কী করবো বাছা, এই সম্প্রতি ছেলের বিয়ে হয়েছে মস্তবড় বনেদী ঘরে। বৌ এখেনে রয়েছে, সে টের পেলে আমাকেই গলায় দড়ি দিতে হবে। সেই ভয়েই তোমাকে এই ঘুষ দিচ্ছি। কিন্তু মা কালীর দিব্যি, যেন আর কেউ জানতে না পারে!
কেষ্টমোহিনীর অবিশ্যি তাতেও জের মরেনি। বলেছে, কিন্তু মা, আমি গরিব মানুষ, দু-দুটো মানুষ পুষি কোথা থেকে? নিতান্ত নিরুপায় বলেই না ওই পঞ্চাশ-ষাট বছরের বুড়োর সঙ্গে বোনঝির বে দিই! কে জানে মা, তোমার মতন এমন জগদ্ধাত্রী ঘরে? আমায় বলেছিলেন দশ বারো বছর হলো পরিবার গত হয়েছে, বেটার বৌরা সেবাযত্ন করে না
কথা শেষ করতে হয়নি কেষ্টমোহিনীকে। ধেই ধেই করে নেচে উঠেছিল দাসগিন্নী।… কী বললে?…পরিবার গত হয়েছে? আসুক সে আজ! বুঝিয়ে দেব কেমন গত হয়েছে! তারপর আবার দেব কিছু বলে প্রতিশ্রুতি।
আর সেই হোমিওপাথি ডাক্তারটা! কেলে জোঁক! তার জন্যে অবশ্য আর একটা ছেলে ভাড়া করতে হয়েছিল। এমন চাঁদের টুকরোর মত ছেলে সেই কেলে চামচিকের, তা বিশ্বাস করানো যেত না।
তা সেবারে অসুবিধেতেও কম পড়তে হয়নি! লোকটার সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি!
তা কেষ্টমোহিনী কি আর হার মানবে? বলে কত বছর মিনার্ভা থিয়েটারে প্লে করে এল। দজ্জাল ঝি-চাকরানীর পার্ট করতে হলেই কেষ্টাকে ডাক পড়তো। মুখের চোটে পাড়ার লোক জড়ো করে ডাক্তারকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল কেষ্টমোহিনী। মজা এই, ডাক্তারের কথাই অবিশ্বাস করলো সবাই। অবিশ্বাস করার হেতুও ছিল। চিকিৎসা করতে এই পাড়াতেই চব্বিশ ঘণ্টা গতিবিধি ডাক্তারের।
তাছাড়া কমলিও তো কম অভিনয় শেখেনি! কেষ্টমোহিনীকেই তাক লাগিয়ে দেয় মাঝে মাঝে। তার মাঝে মাঝে মাথা হেঁট করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা, মাঝে মাঝে মাসিকে থামানোর জন্যে ব্যাকুলতা, আর মাঝে মাঝে কোলের ছেলেটাকে জাপটে ধরে কান্না–দেখলে সাধ্য কি কেউ তাকে অবিশ্বাস করে!
কখনো বলতে হয় বিয়ে করে পালিয়েছে, কখনো বলতে হয় নষ্ট করেছে। সহায় ওই ননীমাধব। কত কায়দাই করে।
আর কত রকম সাজতে হল কেষ্টমোহিনীকেই! কখনো মা, কখনো মাসি, কখনো দিদিমা! কী করবে? বেয়াড়া মেয়েটা যে রোজগারের সোজা পথটায় কিছুতেই পা দেবে না। মিথ্যে অপবাদের ডালি মাথায় বইবে, মিথ্যে কলঙ্কের কালি মুখে মাখবে, তবু
.
ননী বললো, বলি মাসি, কিছু ছাড়ো-টাছড়া! একেবারে গুম হয়ে গেলে যে! পাওনি কিছু?
পাইনি বলতে পারলেই কেষ্টমোহিনী বাঁচত। কিন্তু কমলি লক্ষ্মীছাড়ীর কাছে কি পার পাওয়া যাবে তাহলে? বাছার যে ননীদার ওপর সাতখানা প্রাণ! ওর কাছে একেবারে সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের ধর্মকন্যে হয়ে বসবেন!
তাই বাধ্য হয়ে বলতে হয় কেষ্টমোহিনীকে, না পেয়ে কি আর ছেড়ে এসেছি?
কত? কত? আশায় আনন্দে দুচোখ জুলজুল করে ওঠে ননীর।
দিয়েছে শখানেক।
শখানেক! ননী গম্ভীরভাবে বলে, মন্দ কি! তাছাড়া এক মাঘে তো শীত পালায় না! দাসত্তা যে গিন্নীর ভয়ে এখনো মাসোহারা দিচ্ছে! বুড়ো ঘুঘু দুর্নামের ভয়ে পুলিস ডাকতে পারে না। জানে তো, ডাকতে গেলে তাকেই পাবলিক মেরে লা করে দেবে একেবারে। হি হি করে হাসতে থাকে ননীমাধব।
টাকা এখুনি নিয়ে কী করবি তুই?
শোন কথা! টাকা নিয়ে কী করবি? নতুন একখানা ভাষা শোনালে বটে মাসি!…ফটোর খরচা নেই আমার? ফিলিমের আজকাল কত দাম জানো? পাওয়াই যায় না। কত কায়দা-কৌশল করে কাটামুণ্ডু ধড়ে জুড়তে হয়, তবে না? তোমার ব্যবসার মূলধন তো ওই ফটো! ওই থেকে কত টাকা তুলছ! অথচ ননীকে পাঁচটা টাকা দিতে হলেই তোমার হাত কাঁপে।
কেষ্টমোহিনী মুখঝামটা দিয়ে বলে ওঠে, আমার জন্যেই শুধু করছিস কিনা! কিসের আশায় খেটে মরছিস, সে আর জানতে বাকি নেই আমার। বলি, আমার মজুরিটা বুঝি কিছুই না?… কত ঝুঁকি নিয়ে একাজ করতে হয় জানিস কিছু? সেবার সেই ভোটের বাবুটার বাড়িতে?-মার খেতে বাকি ছিল শুধু। আমাদের আটকে রেখে পুলিস ডাকতে যায় আর কি! নেহাৎ কমলির বুদ্ধির জোরেই প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছিলাম সেদিন। ও যখন কায়দা করে ঘাড় তুলে বললে,-পুলিস ডেকে জেলে দেবেন এ আর বিচিত্র কথা কি! আইন-আদালত সবই তো বড়লোকের জন্যে! গরিব চিরদিনই চোর, মিথ্যেবাদী, অপরাধী!–তখন কত্তার জোয়ান ছেলেটা কেমন ঘাবড়ে গিয়ে বাপের দিকে কটমটিয়ে তাকালো। তারপর দারোয়ানকে বললো গেট খুলে দে।…পথে এসে এক ঘণ্টা ধরে হাত-পা কেঁপে বুক ধড়ফড়িয়ে মরি।