ইন্দু চুনকালি দিয়েছে? দিশেহারা চন্দ্রনাথ তখন হতভম্ব হয়ে বলে উঠেছিলেন, কী বলছে দিদি, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না!
বুঝতে পারবিনে চন্দর, বোঝবার কথা নয়। তবু ভগবান কাটার চাবুক মেরে বুঝিয়ে ছাড়লেন ইন্দু আমাদের লুকিয়ে বিয়ে করেছে, ছেলের বাপ হয়েছে।
কী পাগলামি করছো দিদি? বলেছিলেন চন্দ্রনাথ, চিৎকার করে নয়, তীব্র প্রতিবাদে নয়। নীহারকণার মাথায় হঠাৎ কিছু ঘটেছে ভেবে হতাশ বিস্ময়ে বলেছিলেন, হঠাৎ কি দুঃস্বপ্ন দেখলে?
তা নয়, তা নয় চন্দর, এতদিন তুই আমি দুদুটো আস্ত মানুষ চোখ মুদে পড়ে পড়ে অলীক সুখস্বপ্ন দেখছিলাম, জ্ঞান ছিল না চোখ খুললে পৃথিবীটাকে দেখতে হবে–নোংরা কুচ্ছিত নিষ্ঠুর পৃথিবী!
কিন্তু হয়েছেটা কী?
.
কী হয়েছে সব খুলে বলেছিলেন নীহারকণা। মাঝখানে মাঝখানে খানিক কেঁদে, খানিক মাথা খুঁড়ে। তবু বলেছিলেন। বিকেল থেকে যা যা ঘটেছে, আর সেই কালশত্রু দুটোর সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে সমস্তই খুলে বলেছিলেন নীহারকণা। আর সেই শুনে চন্দ্রনাথ বলে উঠেছিলেন, অসম্ভব! এ হতেই পারে না, ইন্দুর দ্বারা কখনো এ কাজ হতে পারে না।
জোর গলায় বলেছিলেন। যতক্ষণ না জোঁকের মুখে নুন পড়েছিল, ততক্ষণই মাথা নেড়ে নেড়ে বলেছিলেন, এ হতে পারে না দিদি, এ হতে পারে না। এ কোন ষড়যন্ত্রের ব্যাপার।
এখন ভাবছেন চন্দ্রনাথ, কেন বলেছিলাম এ কথা, কেন এত দৃঢ় বিশ্বাস রেখেছিলাম ছেলের উপর? ভাবলেন, আমি কি কোনদিন যাচাই করে দেখেছি তার দ্বারা কী হতে পারে, আর কী হতে পারে না?
বারবার ভাবলেন চন্দ্রনাথ, তিনি কি কোনদিন কৌতূহলবশেও একবার উঁকি মেরে দেখতে গিয়েছেন, ইন্দ্রনাথের সমিতিটা কী, কী কাজ সেখানে হয়?
কত সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেরাও তো কত রকমের গুপ্ত সমিতি করে, দেশের কল্যাণের নাম করে অকল্যাণের আগুন জ্বালিয়ে বেড়ায়, শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মার্জিতরুচি যুবকের দল দেশকে নিয়ে কতই না ছিনিমিনি খেলে বেড়ায়, ইন্দ্রনাথও যে তেমন কোন দলে গিয়ে পড়েনি কে বলতে পারে? আর হয়তো সেই সূত্রে কখন কোন ফ্যাসাদের মধ্যে মাথা গলাতে গিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। বাড়িতে জানাতে পারেনি ভয়ে আর লজ্জায়।
বারবারই ভাবতে চেষ্টা করলেন, অসম্ভব নয়, অসম্ভব নয়–তবু বারবারই মন ক্লিষ্ট পীড়িত সঙ্কুচিত হয়ে ওঠে এই নিষ্ঠুর সত্যটা স্মরণ করে তার ছেলে এই হলো!
না, এত যন্ত্রণা চন্দ্রনাথের ইন্দ্রনাথ কোন দুর্বলতার বশে বিয়ে করে বসেছে বলে নয়, লজ্জায় ভয়ে সে সংবাদ গোপন করেছে বলেও নয়, যন্ত্রণা–ইন্দ্রনাথ তার সেই স্ত্রীপুত্রকে ত্যাগ করেছে, করেছে তাদের অনুমুষ্টি বন্ধ করে দেওয়ার মত নীচতা!
কী লজ্জা! কী লজ্জা!
.
আবার এই লজ্জার গ্লানির মধ্যেও চোখের সামনে ভেসে উঠছে ছেলের সেই সুকুমার কান্তি দেবোপম মূর্তিখানি। তখন আর হিসেব মেলাতে পারছেন না চন্দ্রনাথ। রাগ আসে না, রাগ করতে জানেন না চন্দ্রনাথ, রাগ করতে শেখেননি কখনো, তাই বারবার মেয়েদের মত চোখের জল মুছেছেন বসে বসে। জলবিন্দুটি পর্যন্ত মুখে দেননি।
তারপর?
.
অনেক রাতে স্তব্ধতার বুক চিরে নীহারকণার চিৎকার উঠল।
উদভ্রান্তের মত ছুটে নেমে এলেন।
আর যখন নীহারকণা পাগলের মত কেঁদে উঠলেন, ওরে চন্দর, ছুটে বেরিয়ে দেখ লক্ষ্মীছাড়া ছেলে কোনদিকে গেল! ও চন্দর, কেন মরতে আমি তাকে বলতে গেলাম,–তোর বাপ মনের ঘেন্নায় তোকে তেজ্যপুত্তুর করেছে–সেই অভিমানে তক্ক করলো না, প্রতিবাদ করলো না, জন্মেরশোধ চললাম বলে চলে গেল। যা চন্দর ছুটে যা, ঝোঁকের মাথায় যদি কী না কী সর্বনাশ করে বসে কী করব, আমি কী করব? তখন সমস্ত কলরোল, সমস্ত বিপদাশঙ্কা ছাপিয়ে অভূতপূর্ব একটা শান্তিতে বুকটা ভরে ওঠে চন্দ্রনাথের। মনের গভীরে অন্তরালে কে যেন প্রার্থনা করতে থাকে–তাই হোক, তাও ভাল। ভয়ানক একটা কিছুই করে বসুক ইন্দ্রনাথ।
মুখ থাকুক চন্দ্রনাথের নীহারকণার কাছে। মুখ থাকুক ইন্দ্রনাথের জগতের কাছে, থাকুক সভ্যতা আর সম্ভ্রমের কাছে। পরাজিত হোন্ নীহারকণা।
এ এক আশ্চর্য হৃদয়-রহস্য! চিরদিন যে মানুষটাকে ভয় ভক্তি আর সম্মানের উচ্চাসনে বসিয়ে রেখে এসেছেন চন্দ্রনাথ, আজ একান্ত কামনা করছেন তার পরাজয় ঘটুক! যদি সে কামনা পূরণের জন্যে চরম মূল্য দিতে হয়, তাও হোক। চন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেননি পুত্রের গ্লানি, নীহারকণা করেছিলেন।
এখন? বেশ হয়েছে। বেশ হয়েছে! আঃ ইন্দ্র! নিরীহ গোবেচারা চন্দ্রনাথের হঠাৎ এ যেন এক অদ্ভুত নিষ্ঠুর মনোবৈকল্য।
আর একবার আছড়ে পড়লেন নীহারকণা, তবু সঙের মতন দাঁড়িয়ে রইলি চন্দর? আমিই কি তবে এই রাতদুপুরে রাস্তায় বেরোবো?
চন্দ্রনাথ চেতনা ফিরে পেলেন। রাস্তায় বেরোলেন।
.
ননীমাধব এসে দাঁড়ালো হাসতে হাসতে।
কী মাসি কী খবর? হলে কিছু? কেষ্টমোহিনী মুখের হাসি গোপন করে, মুখে কিছুটা উদাস ভাব এনে বলে, এখন তো নগদ বিদেয়। তারপর দেখা যাক। কে জানতো ও রকম দজ্জাল একটা পিসি আছে ঘরে!
হৃদয়-উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করতে রাজী নয় কেষ্টমোহিনী। বেশি ব্যক্ত করলেই তো ননীকে বেশি বেশি ভাগ দিতে হবে। তবে ভেতরে ভেতরে আহ্লাদ উথলে উঠছিল। এখন তো নগদ বিদায় একশো টাকা! আর ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি? বৌ নাতিকে ঘরে তুলতে পারুন না পারুন, মাসে মাসে একশো টাকা করে মাসোহারা দেবেন নীহারকণা। এ প্রতিশ্রুতি পেয়েছে কেষ্টমোহিনী।