চললাম! আবার চললাম কি? নীহারকণা চেঁচিয়ে ওঠেন, চললাম মানে কি?
মানে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে বুঝি? তা হতে পারে। মা-মরা ছেলেকে মানুষ-টানুষ করলে এতদিন ধরে। কিন্তু পিসিমা, বুঝলাম মানুষ করেছ, এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে কিছুই করোনি। শুধু পালনই করেছ। ভেবেছ শুধু খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখছি, আবার কি! যাক্, সে ঋণ তো শোধ হবার নয়, রইলই সে ঋণের বোঝ।
.
নিচে চাকর-বাকররা চমকে উঠল নীহারকণার গগনভেদী চিৎকারে।
ওরে, ওরে সর্বনেশে ছেলে, সত্যি চলে যাচ্ছিস মুখের খাবার ফেলে?..চন্দর, অচন্দর, কী কাল ঘুম ঘুমোচ্ছিস তুই হতভাগা! ওরে কী করতে কী হলো,…ইন্দু যে আত্মঘাতী হতে গেল! ওমা, কি কালনাগিনীরা এসেছিল রে! ওরে আমি কেন আত্মঘাতী হচ্ছি না!
কথাগুলো কোনখান থেকেই স্পষ্ট শোনা যায় না, শুধু বামুন-চাকর-দারোয়ান তিনটে লোক হাতের তাস ফেলে দোতলায় উঠবার সিঁড়ির দিকে দৌড়তে থাকে, ওদিকে তিনতলায় চন্দ্রনাথ সদ্য-ঘুম-ভাঙা বিপর্যস্ত দেহে দৌড়তে থাকেন দোতলায় নামবার সিঁড়ির ওপর।
ইন্দ্রনাথ চাকর-বাকরগুলোর পাশ কাটিয়ে তরতর করে নেমে যায়,– এই শিগগির ওপরে যা, পিসিমার মাথা গরম হয়ে গেছে। আমি ডাক্তার আর বরফ আনতে যাচ্ছি।
অবস্থাটা খুবই স্বাভাবিক। তাড়াতাড়ি ডাক্তারের দরকার হলে অমনি করেই নেমে যায়। কে ভাবতে পারবে বাড়ির প্রাণের প্রাণ, সোনার কৌটোয় রাখা সাতশো রাক্ষসের একপ্রাণ দাদাবাবু অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল চিরদিনের মত!
তারা স্ফুর্তিসেই ছুটল।
পিসিমা মাথা গরম করে চেঁচাচ্ছে, এ যে একটা মজাদার খবর!
২. চন্দ্রনাথের ক্ষমতা
চন্দ্রনাথের ক্ষমতা নেই খুব বেশী উত্তেজিত হবার।
পঁচিশ বছর বয়সে বিপত্নীক, তারপর কেটে গেল আরো আঠাশটা বছর। নিজের সংসারে প্রভূত উপার্জন করেও কেমন একটা দাবিহীন মনোভাব নিয়েই কেটে গেল জীবন। কেবল যে দিদি নীহারকণার প্রতিই তিনি কৃতজ্ঞ তা নয়, দাসদাসীর প্রতিও যেন নিতান্ত কৃতজ্ঞ চন্দ্রনাথ। তার এতটুকু কাজ কেউ করে দিলে কৃতার্থম্মন্যের মত থাক থাক–এত কেন করে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
আর ছেলে? শৈশবকাল থেকে নিজের ছেলেকে রাজপুত্রের সম্মান দিয়ে আসছেন চন্দ্রনাথ। ছেলে যদি একবার স্বেচ্ছায় তার কাছে এসে বসতো, চন্দ্রনাথ বর্তে যেতেন। সেই থেকে এই অবধি একই ভাব। ইন্দ্রনাথ যা কিছু করেছে কখনো বাধা দেননি। নীহারকণার ভাষায় যা ভূতের ব্যাগার–সেই সমাজকল্যাণ সঙ্রে ব্যাপারেও অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে এসেছিলেন ছেলেকে।
ছেলের বিয়ে? সে সম্বন্ধেও স্পষ্ট কোন চেতনা ছিল না চন্দ্রনাথের। নিশ্চিন্ত আছেন, দিদি যা ভাল বুঝবেন করবেন।
কিন্তু নীহারকণা? নীহারকণার পক্ষে ইন্দুর বিয়ে-বিয়ে করে যতটা ব্যস্ত হওয়া উচিত তা কি নীহারকণা হয়েছেন কোনদিন? হয়তো হননি। পরমাসুন্দরীর খোঁজে বৃথা গড়িয়ে দিচ্ছেন দিন মাস বছর। কে বলতে পারে এ মনোবৃত্তির পিছনে কী আছে! হয়তো তার চিরবঞ্চিত জীবনে, কেবলমাত্র দৈবানুগ্রহে যে দুর্লভ রত্নটির মালিকানা পেয়েছিলেন, সেটি চট করে হাতছাড়া করে ফেলতে মন সায় দিচ্ছে না!
কিন্তু একথা নীহারকণা নিজেই বোঝেন না, তা চন্দ্রনাথ।
চন্দ্রনাথ এত কথা বোঝেন না। চন্দ্রনাথ নিশ্চিন্ত চিত্তে দিনের পর রাত্রি আর রাত্রির পর দিনের চক্রে পাক খেতে খেতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বে-প্রৌঢ়ত্ব থেকে বার্ধক্যের পথে। মনের পরম আশ্রয় দিদি আছেন। পিঠোপিঠি ভাইবোন, এক বছরের বড় দিদি, তবু চন্দ্রনাথের কাছে দিদি অনেক উঁচুতে।
হঠাৎ আজ নীহারকণা যখন অজস্র কান্নাকাটি, আস্ফালন শেষ করে চলে গেলেন, তখন স্তব্ধ হয়ে ভাবতে লাগলেন চন্দ্রনাথ,…তিনি কি কোনদিন ছেলের প্রতি উচিত কর্তব্য করেছিলেন?… তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়েছিলেন?
তবে কেন ইন্দ্রনাথ কিছুতেই একাজ করতে পারে না বলে জোর করছিলেন! কেন ভাবতে পারছিলেন না সম্ভব হওয়াও অসম্ভব নয়!
চন্দ্রনাথ কি ইন্দ্রনাথকে চেনেন? চেনবার চেষ্টা করেছেন কোনদিন?
ইন্দ্রনাথের জীবনের পরিধি কতদূর বিস্তৃত সে খবর কি চন্দ্রনাথ রাখেন? একদা মাতৃহীন শিশুকে দিদির কাছে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ছিলেন, আজও রয়ে গেছে সে নিশ্চিন্ত। সেই দুরন্ত শিশুটা ক্রমশ মাপে বড় হয়ে উঠেছে, উঠেছে বিদ্বান হয়ে, চোখজুড়ানো রূপ নিয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, এই দেখে দেখেই চন্দ্রনাথের বুক ভরে গেছে। সেই ভরা বুক আর ভরা মনের নিশ্চিন্ত নিয়ে একভাবে কাটিয়ে যাচ্ছিলেন, কোনদিন কি খেয়াল করেছেন শুধু মাপে বড় হওয়াই শেষ কথা নয়, তার মাঝখানে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে পুরো পরিণত একটা মানুষ!
যে যুবক হয়ে উঠেছে, সে যদি যৌবনের ধর্ম পালন করে থাকে, তবে এত ভয়ংকর রকম অবাক হবার কী আছে? প্রকৃতিই তো তার মধ্যে বিকশিত করে তুলেছে প্রেম, কামনা, সৃষ্টির বাসনা! আমার সন্তান একদা শিশু ছিল বলে চিরদিনই সে শিশু থাকবে এইটাই কি বুদ্ধিমানের যুক্তি? প্রকৃতি তার মধ্যে বসে আপন কাজ করে চলবে না?
এখন এত কথা ভাবছেন চন্দ্রনাথ, কিন্তু তখন ভাবতে পারেননিযখন নীহারকণা এসে আছড়ে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, চন্দর, মানুষ চিনি বলে বড় অহঙ্কার ছিল, সে অহঙ্কার চূর্ণ করে দিয়েছে ভগবান! ইন্দু আমাদের মুখে চুনকালি দিয়েছে!