পিসিমা, বোস। ইন্দ্রনাথও কী ভেবে সহসা শান্তভাব ধারণ করে। ঠাণ্ডা গলায় বলে, হঠাৎ ক্ষেপে গেলে কিসে, শুনতে দাও আমাকে। তড়বড় করে এমন কতকগুলো কথা বললে, যার বিন্দুবিসর্গ অর্থও আমার মাথায় ঢুকলো না।…কী হয়েছে কী? কে তোমাকে কী বলে ক্ষেপিয়ে গেছে?
নীহারকণা স্তিমিত ভাবেই বলেন, হঠাৎ ক্ষেপবার মেয়ে আমি নই ইন্দু। তুই আজ আমাকে নতুন দেখছিস না। উপযুক্ত প্রমাণ দেখিয়েছে, তবেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি।
কিন্তু বিশ্বাসটা কী নিয়ে? সে কথা তো বলতে বাকি রাখিনি ইন্দু।–তুই ধর্মের নামে শপথ করে বল, তিন বছর আগে অরুণা বলে কোথাকার কোন কলোনির একটা মেয়েকে বিয়ে করিসনি?… বল্ তোর মরা মায়ের ছবি ছুঁয়ে, সে মেয়ের গর্ভে তোর সন্তান হয়নি?..বল, বছরখানেক তুই তাদের মাসোহারা দিয়ে–এখন মাসোহারা বন্ধ করিসনি?
.
মুহূর্তকাল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ইন্দ্রনাথ। তারপর নিতান্ত শান্ত, নিতান্ত স্থির স্বরে বলে, আমার মরা মা-র ছবি ছুঁয়ে কোন শপথ আমি করবো না পিসিমা।…না, নিজেকে বাঁচাবার জন্যেও না। বুঝতে পারছি কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার হয়েছে, আমার সুনাম নষ্ট করে হয়তো কারো কোন স্বার্থসিদ্ধি হবে। কিন্তু সে চুলোয় যাক। তুমি এবং বাবা সেকথা বিশ্বাস করেছ, এইটাই হচ্ছে আমার জীবনের পরম সত্য?
আমার মরা মায়ের ছবি ছুঁয়ে শপথ করতে বলছিলে পিসিমা? কী এসে যেত তাতে?…আমার জীবনে ওই ছবির মা তো চিরদিনই মৃত। আমার নিজের মা বেঁচে থাকলে কখনোই আমায় এই অসম্মান করতে পারতেন না। পারতেন না কোন একটা ইতরলোকের কথাকে বিশ্বাস করে আমাকে অবিশ্বাস করতে।…আচ্ছা ঠিক আছে?
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়ায় ইন্দ্রনাথ। মুহূর্তে যেন কী এক পরম মুক্তির আনন্দ অনুভব করে সে। বুঝি ঠিক মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেই এ রকম মুক্তির স্বাদ পায় মানুষ। ভালই হল! ভালই হল! খসে পড়ল মিথ্যা ভালবাসার জীর্ণ খোলস! খসে পড়ল দাবিহীন আশ্রয়ের আশ্রয়!
কিন্তু নীহারকণা চমকে ওঠেন। এ কী! চলে যায় যে! এ যুগের সর্বনেশে ছেলে এরা, সব পারে! এখুনি পারে চিরকালের মত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে চিরদিনের মত চলে যেতে।
ইন্দু! ছুটে এসে পিছন থেকে ইন্দ্রনাথের পাঞ্জাবির কোণটা চেপে ধরেন নীহারকণা। সর্বনাশা ছেলে, মুখের খাবার ফেলে যাচ্ছিস কোথায়?
ফিরে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রনাথ একটু হাসে, যাচ্ছি যেখানে মুখের কাছে খাবার এসে জোটে না!
আমাদের ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিস তুই?
ত্যাগ! আমি! আর একটু হাসে ইন্দ্রনাথ, সে তো অনেক আগে তোমরাই আমাকে করেছ!
নীহারকণা কেমন একটা হতাশ অসহায় মুখে বলেন, তোর মা-র কথা তুলে তুই আমাকে খোঁটা দিয়েছিস ইন্দু, আমার কথা আর আমি বলবো না, কিন্তু তোর বাবার সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারবি তুই?
বাবা তো রীতিমত অনশনব্রত করে আমাকে ত্যেজ্যপুত্র করেছেন পিসিমা, আমি তো মুক্ত!
কিন্তু কিন্তু সব অপবাদই যদি মিথ্যে, সে কথা তুই পষ্ট করে বোঝবি না?
না।
চিরদিনের দুর্জয় অভিমানিনী নীহারকণা অনেকক্ষণ যুঝেছেন, আর পারবেন কি করে? তাই মুঠোয়-ধরে-থাকা জামার খুঁটটা ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর ভাবে বলেন, গঙ্গায় যতক্ষণ জল আছে ইন্দু, আমাকে কেউ কিছুতেই ভয় পাওয়াতে পারবে না, ভাবনা শুধু চন্দরের জন্যে –য়াক, তার ভাবনা ভগবান ভাববেন। তবে একটা কথা তোকে শুনে যেতেই হবে। ঈশ্বর জানেন, কার দোষ কার ভুল, তবু রক্তমাংসের মানুষ আমরা, ঈশ্বরের চোখ দিয়ে তো দেখতে পাই না, এই রক্তমাংসের চোখ দিয়েই দেখি। অরুণা বলে যে মেয়েটা এসেছিল তার ছেলে নিয়ে মাকে সঙ্গে করে, দেখেছি তার চোখের জল, দেখেছি তার ছেলের মুখ-চোখ-রং-গড়ন, দেখেছি তার কাছে ফ্রেমে বাঁধানো ফটো। তোর আর তার দুজনের পাশাপাশি ফটো। সবই যদি আমার চোখের ভ্রম, সবই যদি আমার বোঝবার ভুল, বলছবি সে পেল কোথায়?
পাশাপাশি ফটো! কবে কোথায় কার সঙ্গে পাশাপাশি ফটো তুলল ইন্দ্র? বিমূঢ়ভাবে ইন্দ্র বলে, কী বললে? পাশাপাশি ফটো?
হ্যাঁ। নীহারকণা এবার আত্মস্থতায় ফিরে আসেন,–ওই ফটো দেখেই আমার জোঁকের। মুখে নুন পড়লো। নইলে আমিই কি আগে তাদের পুলিসে ধরিয়ে দিতে চাইনি?…ফটো তো আর মিছে কথা বলে না?
ফটোও মিছে কথা বলে পিসিমা। এই বিজ্ঞানের যুগে গাছ, মাটি, নদী, পাহাড় সকলকে দিয়েই মিছে কথা বলানো যায়! সত্যি-মিথ্যের বিচার নিজের বিবেকের কাছে। আমায় যদি কেউ এমন ফটো দেখাতে যে তুমি কারুর বুকে ছুরি বসাচ্ছো, আমি সে ছবিকে বিশ্বাস করতাম কি? তবে বুদ্ধির কাজ করতে, যদি সে ফটোটা আমাকে দেখাতে পারতে! দেখতাম কার এই ষড়যন্ত্র? কিন্তু না, সে বুদ্ধি তোমাদের নেই, সে ধৈর্যও নেই। আমায় অবিশ্বাস করাটা সহজ, সেটাই করেছ?
ওরে নেমকহারাম ছেলে, সে চেষ্টা কি আমি করিনি? দিশেহারা হয়ে নিজের গলা থেকে ইষ্টদেবতাম কবচসুষ্ঠু হারছড়াটা খুলে দিতে গেলাম ওই ফটোর বদলে। দিল না। চোখের জলে ভাসতে লাগলো ছুঁড়ি, মা বললো আর তো কোন সম্বল নেই ওর, ওইটুকু সম্বল। কোন্ প্রাণে : বলবো ওটুকু হাতছাড়া করতে?
– দেখ পিসিমা, সব যেন ধোঁয়ার মত লাগছে, মনে হচ্ছে কোন ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ছি। আচ্ছা যাক, এ রহস্য কোন একদিন ভেদ হবেই।চললাম। হেঁট হয়ে নীহারকণাকে প্রণাম করে ইন্দ্রনাথ।