- বইয়ের নামঃ আলোর স্বাক্ষর
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. কমলা চুপ
আলোর স্বাক্ষর – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
কমলা চুপ করে জানলায় বসেছিল।
এইমাত্র কেষ্টমোহিনী যাচ্ছেতাই করে গেছে। স্পষ্ট বলে গেছে কমলার এই সৌখিন পেশার উপর ভরসা রেখে আর চলতে রাজী নয় সে। সোজাপথের মানুষ কেষ্টমোহিনী, সহজ সোজা পথটাই বোঝে। ঘুরপথের ঘূর্ণিকে বিশ্বাস কি? মানুষ ঠকিয়ে বেড়িয়ে যে উপার্জন, তার ওপর আবার নির্ভর! গতর খাটাও, ঘরে টাকা তোল! আর কমলা যদি একবার সে পথে নামে, তাহলে তো বাঁকের ওজনে টাকা তুলবে ঘরে! শুধুই যে বয়েস আছে তা তো নয়, ভগবানের দেওয়া মস্ত একটা ঐশ্বয্যি রয়েছে কমলার। পরীর মতন রূপ। সে রূপ কি ওই হতভাগা ননীর কুঁড়েঘর আলো করে বসে থাকবার জন্যে?
আর যে আশায় বুক বেঁধে কমলাকে খাইয়ে পরিয়ে এত বড়টি করে তুললো কেষ্টমোহিনী, সে আশায় ছাই ঢেলে দিয়ে, গেরস্থর বৌটি হয়ে নিজের সংসারটি পাততে সরে পড়াই কি ধর্ম হবে কমলার?
কমলা অবশ্য কেঁদে ফেলে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল,কমলার যদি সংসার হয়, সে সংসারে কি কেষ্টমোহিনীর ঠাই হবে না? কেষ্টমোহিনী সে কথা ব্যঙ্গহাসি হেসে তুড়ি দিয়ে উড়িয়েছে। হুঁ, বলে অমন সবাই! এ যুগে বলে পেটের ছেলেমেয়ের সংসারেই বুড়িদের ঠাই হয় না, তার আবার পাতানো বোনঝির সংসারে! কেষ্টমোহিনী কমলাকে খাইয়ে পরিয়ে বড়টি করেছে, এ মান্য দেবে ননী? মানবে সে কথা? বলে জন্মদাতা পিতার ঋণই মানতে চায় না এখনকার ছেলেরা! ওসব ঘেঁদো কথায় ভোলবার পাত্রী কেষ্টমোহিনী নয়। তাছাড়া ননী যে তাকে কী দুচক্ষের বিষ দেখে সে কথা কি জানতে বাকী আছে কেষ্টমোহিনীর?
না–কমলার কাতরতায় আর কান দেবে না কেষ্টমোহিনী, লক্ষ্মীছাড়া ননীকেও আর এ বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।
.
ঘণ্টাখানেক ধরে বুঝিয়ে জপিয়ে, খিঁচিয়ে শাসিয়ে, ভয়ংকর একটা দিব্যি গেলে, ঘটি-গামছা নিয়ে এই খানিক আগে গঙ্গায় গেল কেষ্টমোহিনী। কিছুদিন থেকে এই এক বাতিক হয়েছে তার, নিত্য গঙ্গাস্নান। তা বাতিকটা হয়ে ভালই হয়েছে, ঘণ্টা তিনেকের মত নিশ্চিন্দি। গঙ্গাস্নানে গিয়ে ফোঁটা-তেলক কাটবে কেষ্টমোহিনী, পাঁচটা সখী-সঙ্গিনীর সঙ্গে আলাপ-সালাপ করবে, যত দেব দেবী, শিবশিলা আছেন আশেপাশে, তাদের মাথায় জল ঢালবে, গঙ্গার ঘাটে যে বাজার বসে, সেখান থেকে দেখে শুনে দরাদরি করে রোজের বাজারটা সারবে, তারপর এক হাতে মাছ তরকারি, আর-এক হাতে ঘটি-গামছা নিয়ে রৈ রৈ করতে করতে বাড়ি ঢুকবে। ইত্যবসরে যদি কমলা সময়ের তা বুঝে উনুনের আঁচটা না ধরিয়ে রাখলো, তাহলে অবশ্য রক্ষে নেই। রৈ রৈ কাণ্ডর মাত্রা তাহলে চরমে উঠবে।
সময়ের তাক বুঝতে দশমিনিট অন্তর ঘড়ি দেখতে হয় কমলাকে। তবু যেইমাত্র বেরিয়ে যায় কেষ্টমোহিনী, কমলা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। খানিকক্ষণের জন্যে যেন বুকের পাষাণভার নামে। একটুক্ষণ আপনার মন নিয়ে বসে থাকতে পায়।
আর এইটুকুই তো ননীর সময়।
.
কেষ্টমোহিনী যতই গালমন্দ করুক, আজও ননী এল। ঘরে ঢুকে বলে উঠল, বিরহিণী রাইয়ের মতন বসে আছিস যে? মাসির রান্নার জোগাড় করছিস না?
কমলা জানলা থেকে নেমে এসে চৌকির ওপর বসে বলে, এই মাত্তর গেল!
এই মাত্তর? কেন, বেলা তো অনেক হয়েছে!
এতক্ষণ আমার মুণ্ডপাত করছিল।
উঃ, কবে যে বুড়িটার হাত থেকে রেহাই পাবি।
রেহাই আর পেয়েছি! কমলা নিশ্বাস ফেলে বলে, এ জীবন থাকতে নয়। একদিন এসে দেখবে কমলি ওই কড়িকাঠে ঝুলছে!
মেজাজ খারাপ করে দিসনি কমলি, ননীও চৌকিটায় কমলার গা ঘেঁষে বসে পড়ে বলে, কড়িকাঠ আমারও আছে, আছে রেললাইন, দোতলা বাস, মালের লরী-বুঝলি?
ওঃ, ভারী মহিমা দেখানো হচ্ছে! বেটাছেলে, উনি এসেছেন আত্মহত্যের ভয় দেখাতে! লজ্জা করে না?
লজ্জা! ননী ম্লান হেসে একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, সে কথা আর বলে লাভ কি বল্? তার যখন কোনও প্রমাণ দিতে পারছি না? সেই দুঃখেই তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় বিষ খাই কি রেললাইনে কাটা পড়ি! পারি না শুধু
পারো না শুধু আমার জন্যে, কেমন? কমলা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, আমাকে আর তুমি কাব্যিকথা শোনাতে এসো না ননীদা, ঢের হয়েছে। কেন, পৃথিবীতে আর কোথাও একটা চাকরি জোটাতে পারো না? পালাতে পারো না আমাকে নিয়ে?
চাকরি জোটানো যে কী বস্তু তা যদি জানতিস, তাহলে এমন কথা বলতিস না।
জানবো না আর কেন, হাড়ে হাড়েই জানছি। দেখছি তো প্রত্যক্ষ, যেমন পদের চাকরিতে বিয়ে করবার সাহস হয় না, বৌকে দুটো ভাত দেবার ভয়ে তেমন চাকরি ছাড়তেও যখন এত আতঙ্ক, তখন আবার বুঝতে বাধা কি যে, চাকরি হচ্ছে আকাশের চাঁদ! তাই তো বলছি ননীদা–ধরে নাও কমলি মরেছে। হঠাৎ একঝলক জল উপচে ওঠে কমলার ভাসাভাসা চোখদুটোয়। বোধ করি এ জল নিজেরই মৃত্যুশোকে।
.
ননী কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, আর একটা চান্স নে কমলি, তারপর দেখিস যে করে পারি তোকে এই নরকপুরী থেকে উদ্ধার করবো।
ও রকম প্রতিজ্ঞা তো অনেকবার করলে।
তা বটে! ননী একটু চুপ করে থেকে ফের একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ছবিটা এনেছিলাম রেখে যাই। সত্যিই বলেছিস, হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া গরিবের আবার প্রতিজ্ঞে!
ওঃ, বাবুর অমনি রাগ হয়ে গেল?