বামুন মেয়ে, তুমি তোমার কাজে যাও। গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ দেয় অতসী। অসহ্য লাগছে ওর স্পর্ধা।
বামুন মেয়ে হঠাৎ আদেশে থতমত খেয়ে চলে যায়। কিন্তু অতসী নড়তে পারে না, স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে।
ওর এসব কথার অর্থ কি? এত কথা কেন? এ কি শুধুই বেশি কথা বলার অভ্যাস? না আর কিছু?
.
গালটা জ্বালা করলেও গালে হাত দেবে না সীতু, কাঠ হয়ে বসে থাকবে সেই ওর জানলার ধারে, সংসারের দিকে পিঠ ফিরিয়ে।
এ তো শুধু একটা চড়া নয়, এ বুঝি সীতুর ভবিষ্যতের চেহারার আভাস।
তাহলে অতসীও এবার শাসনের পথ ধরবে। মৃগাঙ্ক ডাক্তারের মন রাখতে তার অনুসরণ করবে। বাপের উপর রাগ ছিল, মায়ের উপর আসছে ঘৃণা। ঘৃণা আসছে ওই বিশ্রী লোকটাকে মা ভয় করে বলে, ভালবাসে বলে।
সীতুর বয়েস কি মাত্র সাড়ে আট?
এত কথা তবে শিখল কি করে সীতু? কে শেখালো এত প্রখর পাকামি? এই প্যাচালোপাকা বুদ্ধিটা কি তা হলে সীতুর পূর্বজন্মার্জিত?
কে জানে কি!
সীতু তার ছোট্ট দেহের মধ্যে একটা পরিণত মনকে পুষতে যন্ত্রণাও তো কম পায় না?
আচ্ছা, তবে কি এবার থেকে বাবাকে ভয় করবে সীতু? করবে ভক্তি? মার মত ভালও বাসবে? ভাববে বাবা কত কষ্ট করছেন তাদের জন্যে?
চিন্তার মধ্যেই মন বিদ্রোহ করে ওঠে। বাবাকে সীতু কিছুতেই ভালবাসতে পারবে না, কখনো না। তার জন্যে মায়ের কাছে মার খেতে হলেও না।
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর বোধকরি জলতেষ্টা পাওয়ায় উঠল সীতু। উঠে দেখল, সামনেই বারান্দার রেলিঙের তারে বাবার রুমাল দুটো শুকোচ্ছে ক্লীপ আঁটা। বোধহয় মাধব তাড়াতাড়ির দরকারে এখানে শুকোতে গিয়ে গেছে, এইখানটায় একটু বোদ এসে পড়েছে বলে।
রুমাল দুটো ঝুলছে, বাতাসে উড়ছে ফরফর করে, সীতু সেদিকে একটু তাকিয়েই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে পা উঁচু করে হাত বাড়িয়ে আটকানো ক্লীণ্টা টেনে খুলে নেয়, আর মুহূর্তের মধ্যেই রুমাল দুটো কোথায় ছুটে চলে যায় রাস্তার ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে।
ওটা সম্পূর্ণ চোখ ছাড়া হয়ে গেলে সীতুর মুখে ফুটে ওঠে একটা ক্রুর হাসি। দরকারের সময় রুমাল না পেলে বাবা কি রকম রাগ করে সীতুর জানা। লোকানটা যতই তুচ্ছ হোক, বাবার অসুবিধে তো হবে!
অতসী দূর থেকে তাকিয়ে দেখে আড়ষ্ট হয়ে চেয়ে থাকে, ছুটে এসে বকবে এমন সামর্থ্য খুঁজে পায় না মনের মধ্যে।
অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে গিয়ে আলমারি থেকে দুখানা ফরসা রুমাল বার করে রেখে : দেয় মৃগাঙ্কর দরকারী জায়গায়।
.
গালের জ্বালাটা যেন একটুখানি জুড়োল। আবার যেন চারিদিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে সীতুর। ঠিক হয়েছে, এই একটা উপায় আবিষ্কার করতে পেরেছে সীতু বাবাকে জব্দ করবার। সব সময় সীতুর দিকে কড়া কড়া করে তাকানো, আর ভারী ভারী গলায় বকার শোধ তুলবে সে এবার বাবাকে উৎখাত করে।
আর খুকুটাকে কেবল পাতের খাওয়াবে।
বাবা জব্দ হচ্ছেন এটা ভেবে ভারি মজা লাগে সীতুর। উপায় উদ্ভাবন করতে হবে জব্দ করার।
.
মোজার তলাটা রক্তে ভেসে গেল।
মোজা ভেদ করে কাঁচের কুচিটা পায়ের চামড়ায় বিধে বসেছে। হীরের মত ঝকঝকে ছোট্ট কোণাচে একটা কুচি।
বাড়িতে কী হচ্ছে কি আজকাল? মৃগাঙ্ক ডাক্তার চেঁচিয়ে ওঠেন, রুগী দেখতে বেরবার মুখে নিজেই রুগী হয়ে। মাধে! নেবাহাদুর!
ছুটে এল ওরা, আর সাহেবের দুরবস্থা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। পা থেকে কাঁচের কুচিটা টেনে বার করছেন মৃগাঙ্ক মোজা খুলে, রক্তে ছড়াছড়ি হয়ে যাচ্ছে জায়গাটা।
এইমাত্র জুতো পালিশ করে ঠিক জায়গায় রেখে গেছে মাধব, এর মধ্যে জুতোর মধ্যে কাঁচের টুকরো এল কি করে?
অতসীও এসে অবাক হয়ে যায়–কি করে? কি করে?
কি করে আর! মৃগাঙ্ক তীব্র চীৎকার করে ওঠেন, জুতোর পালিশের বাহার করা হয়েছে, ঠুকে একটু ঝাড়া হয় নি। তুমি শীগগির একটু বোরিক কটন আর ডেটল দাও দিকি! আর এই মেধোটার এ মাসে কদিন কাজ হয়েছে হিসেব করে মিটিয়ে বিদেয় করে দাও।
মেধো অবশ্য কাঁচুমাচু মুখে প্রতিবাদ করে ওঠে, তারস্বরে বোঝাতে থাকে, অন্তত চারবার সে জুতো ঠুকে ঠুকে ঝেড়েছে, কাঁচের কুচি তো দূরের কথা, একদানা বালিও থাকার কথা নয়। কিন্তু মেধোর প্রতিবাদে কে কান দেয়?
মৃগাঙ্ক ডাক্তারের সহ্যশক্তি অগাধ হলেও, এত অগাধ নয় যে চাকরের এতটা অসাবধানতার উপর এতখানি ধৃষ্টতা সহ্য করবেন। তার শেষ কথা আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাক ও!
ডাক্তারের নিজের চিকিৎসা করার সময় নেই। তখুনি উপযুক্ত ব্যবস্থা করে ফের জুতোয় পা গলাতে হয় তাঁকে, মেধো সিঁড়ির কোণে বসে কাঁদছে দেখেও মন নরম হয় না তার।
ফিরে এসে যেন তোমাকে দেখি না বলে চলে যান।
বলনে যতটা জোর ফুটল মৃগাঙ্কর, চলনে ততটা নয়, পা-টা রীতিমত জখম হয়েছে।
কিন্তু কোথা থেকে এল এই তীক্ষ্ণ কোণাচে কাঁচকুচি? মাধবের চোখে অন্নওঠার অশ্রুধারা, অন্যান্যদের চোখে বিস্ময়ের ভীতি, অতসীর চোখে শঙ্কার ধূসর মেঘ।
শুধু অন্তরাল থেকে ছোট একজোড়া চোখ সাফল্যের আনন্দে জ্বলজ্বল করে। ছোট চোখ, ছোট বুদ্ধি, সামান্য অভিজ্ঞতা, তবু ডাক্তারের বাড়ির বাতাসে বুঝি এসব অভিজ্ঞতার বীজ ছড়ানো থাকে।
কাঁচের কুচি ফুটে থাকলে যে বিষাক্ত হয়ে পা ফুলে উঠে বিপদ ডেকে আনতে পারে, একথা এ বাড়ির বাচ্চা ছেলেটাও জানে।