খুকুকে কেন ফেলে দিয়েছিলি?
জিগ্যেস করেছিল অতসী খুকুর ফুলো কপাল সমতল হয়ে যাবার পর। সীতুর তখনো প্রখর হয়ে রয়েছে ললাট লেখা।
একবারে উত্তর দেওয়া সীতুর কোষ্ঠীতে নেই, তাই আবারও ওই একই প্রশ্ন করে অতসী। বলে, বকব না মারব না, কিছু শাসন করব না, শুধু বল ফেলে দিলি কেন? তুই তো ওকে কত ভালবাসিস?
খুকু প্রসঙ্গে চোখে জল এসে গেল সীতুর, তবু জোর করে বলল, পাজীটা আমার কাছে আসে কেন? আমার গায়ে হাত দেয় কেন?
ওমা, তা দিলেই বা- অবোধ অজ্ঞান অকপট সরল অতসী, বিস্ময়ের গুড়ো মুখে চোখে মেখে বলে, তুই দাদা হোস, তোকে ভালবাসবে না?
না, বাসবে না। আমার হাত তো লোনা! আমি গায়ে হাত দিলেই তো রোগা হয়ে যাবে ও, অসুখ করবে!
ছি ছি সীতু, এই তুই ভেবে বসে আছিস? ওমা, কি বোকা রে তুই! সব বড়দেরই হাত ওই রকম। বাচ্চারা তো ফুলের মতন, একটুতেই ওদের অসুখ করে, তাই তো সাবধান হন তোর বাবা।
আমিও তো সাবধান হয়েছি। ঠেলে দিয়েছি।
আর তারপর নিজের কপাল দেওয়ালে ঠুকে ঠুকে ঘেঁচেছিস! তোকে নিয়ে যে আমি কি করব! ওঁকে তুই অমন করিস কেন? উনি কি অন্যায় কিছু বলেন? অতসী দম নেয়, কত বাড়ির কর্তারা কত রাগী হয়, কত চেঁচামেচি বকাবকি করে, দেখিস নি তো তুই, তাই একটুতেই অমন করিস। তুই যদি ওঁকে একটু মেনে চলিস, তাহলে তো কিছুই হয় না। বল এবার থেকে ওঁর কথা শুনবি? যা বলবেন তাতেই বিশ্রীপনা করবি না? উনি তোর কি করেছেন? এই যে খুকুকে নিয়ে কাণ্ডটা করলি, কিচ্ছু বকলেন উনি তোকে? বল, বল সত্যি কথাটা?
সীতু মাথা ঝাঁকিয়ে সত্যি কথাটাই বলে, না বকলেও ওঁকে আমার ছাই লাগে।
বেশ, তাহলে এবার থেকে খুব কসে বকতেই বলব!
আট বছরের একটা ছেলের কাছে নীচুর চরম হয় অতসী, হেসে ওঠে কথার সঙ্গে। হেসে হেসে বলে, বলব সীতুবাবু বকুনি খেতেই ভালবাসে, ওকে খুব বকো এবার থেকে।
আর সীতু? সীতু কঠিন গলায় বলে ওঠে, তোমার কথা আমার বিচ্ছিরি লাগছে।
তবু হাল ছাড়ে না অতসী। তবু বলে, সীতু রে, তোর কি উপায় হবে? নরকেও যে জায়গা হবে না তোর! যে ছেলে মা বাপকে এরকম করে, তাকে কি বলে জানিস? মহাপাপী! শেষটায় কিনা মহাপাপী হতে ইচ্ছে তোর?
একটু বুঝি সঙ্কুচিত হয় ছেলে পাপের ভয়ে, নরকের ভয়ে। অতসী সুযোগ বুঝে বলে, দেখছিস তো ওঁর চব্বিশ ঘণ্টা কত খাটুনি! দিনরাত খাটছেন। কেন? টাকা রোজগারের জন্যেই তো? কিন্তু সে টাকা কাদের জন্যে খরচ করছেন উনি? এই আমাদের জন্যে কিনা? সেই মানুষকে যদি তুমি কষ্ট দাও, গুরুজন বলে একটুও না মানো, তাহলে মহাপাপী ছাড়া আর কি বলবে তোমাকে লোকে?
না, সঙ্কুচিত হবার ছেলে নয় সীতু। কথাগুলো যেন বেনা বনে মুক্তো ছড়ানোর মতই হয়। যার উদ্দেশে এত কথা, সে কথাটি পর্যন্ত কয় না, মুখখানা কাঠ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
তথাপি অতসী ভাবে একটু বোধ হয় নরম হচ্ছে। যে মনটা মাত্র সাড়ে আটটা বছর পৃথিবীর বোদ জল আলো অন্ধকারের উপসত্ত্ব ভোগ করে সবে শক্ত হতে সুরু করেছে, তাকে আর এতগুলো শক্ত কথায় নরম করতে পারা যাবে না। অতএব আরও এক চাল চালে সে। বলে, ভেবে দেখ দিকিন, তোর জন্যে আমি সুষ্ঠু কত বকুনি খাই! এবার প্রতিজ্ঞা কর, আর কখনো ওঁর অবাধ্য হবি না। উনি যা বলবেন
না, প্রতিজ্ঞা করব না।
না, প্রতিজ্ঞা করবি না? এত বড় সাহস তোর? অতসী ক্ষেপে ওঠে হঠাৎ। ক্ষেপে গিয়ে কোনদিন যা না করে, তাই করে বসে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় ছেলের গালে।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে, অসভ্য জানোয়ার বেইমান!
সমস্ত মুখটা লাল হয়ে ওঠে সীতুর, এ গালের রক্তিমাভা ও গালে ছড়িয়ে পড়ে। তবু উত্তর দেয় না সে। গালে হাতটাও বুলোয় না। এক ঝটকায় মার কাছ থেকে সরে গিয়ে বুনন জানোয়ারের মতই ঘাড় গুঁজে গোঁ গোঁ করে চলে যায়। অতসী চুপ করে চেয়ে থাকে।
মনের মধ্যে মৃগাঙ্কর একদিনের একটা কথা বাজে, একটা বাচ্চা ছেলের কাছে আমরা হেরে গেলাম! আক্ষেপ করে বলেছিলেন মৃগাঙ্ক ডাক্তার।
হার মানবে না প্রতিজ্ঞা করেছিল অতসী, ভেবেছিল সমস্ত চেষ্টা দিয়ে, সমস্ত বুদ্ধি প্রয়োগ করে সীতুকে নরম করবে। মানুষের আদিম কৌশল পাপের ভয় দেখানো, তাও করে দেখবে। ছোট ছেলের মন, নিশ্চয়ই বিচলিত হবে মানুষের চিরকালীন নিয়ন্তা নরকের ভয়ের কাছে।
কিন্তু প্রথম চেষ্টাতেই ব্যর্থতা ক্ষেপিয়ে তুলল অতসীকে। তাই মেরে বসল সীতুকে।
এবার কি তবে মারের পথই ধরতে হবে? নইলে মৃগাঙ্ককে কি করে মুখ দেখাবে অতসী?
.
মৃগাঙ্ক ডাক্তারের বাড়িতে ফালতু কোনও আত্মীয় নেই, সবই মাইনে করা লোক। বামুন মেয়েকে তো অতসীই এসে রেখেছে। তবু অতসীর উপর টেক্কা মারে ওরা কাজে, কথায়।
বিশেষ করে বামুন মেয়ে।
সে ছুটে আসে অতসীর এই নীরবতার মাঝখানে। বলে, ঠিক করেছেন বৌমা, মারধোর করে কি আর ছেলে মানুষ করা যায়? যে দেবতার যে মন্তর! আমি তো কেবলই ভাবি এমন এক বগা জেদি গোঁয়ার ছেলেকে কি করে বৌমা না মেরে থাকে? আপনি রাগই করুন আর ঝালই করুন মা, পষ্ট কথা বলব, এমন ছেলে আমি জন্মে দেখি নি। বাপ বলে কথা, জন্মদাতা পিতা, তাকে কি অগ্যেরাহ্যি! সেদিনকে দেখি বারান্দায় টবে একটা গাছ পুঁতছে ছেলে, কে জানে কি এতটুকু গাছ! বাবু এসে বললেন, কি হচ্ছে? বাগান? বকে নয়, ধমকে নয়, বরং একটু হেসে, ওমা বলব কি, বাপের কথার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে গাছটাকে উপড়ে তুলে ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিল। আমি তো অবাক। ধন্যি বলি বাবুর সহ্যশক্তি, একটি কথা বললেন না, চলে গেলেন। আমাদের ঘরে হলে বাপ অমন ছেলেকে ধরে আছাড় মারত। শুধু কি ওই একটা? উঠতে বসতে তো বাপকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য। শান্তরে বলেছে, পিতা সগগো পিতা ধমমো, সেই পিতাকে এত অমান্যি?