যখন আরও ছোট ছিল, যখন সীতু ওই অসহায়ভাবে এলিয়ে পড়ে থাকা মানুষটাকে বাবা বলেই জানত, তখন একদিন অতসী বলেছিল, দাও না একে ফোন করতে শিখিয়ে। ভারী কৌতূহল বেচারার।
তখনো সম্পর্কে অত তিক্ততা আসেনি, তখনো মৃগাঙ্ক এই যে সীতুবাবু বলে ডেকে কথা বলতেন। তাই অতসীর অনুরোধ রেখেছিলেন, কাছে ডেকে বলেছিলেন, এই দেখ, এইভাবে নম্বর ঘোরাতে হয়। আর এই বই দেখে দেখে লোকেদের নাম বার করতে হয়। এখন তুমি ইংরিজি পড়তে পার না, যখন পড়তে পারবে তখন সব বুঝতে পারবে। আচ্ছা এখন দেখ–
নমুনাস্বরূপ নিজের একজন সহকারী ডাক্তারকে ডেকেছিলেন মৃগাঙ্ক। আর একটু হেসে সীতুর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, দেখ, শিখলে তো? এখন ধর যদি হঠাৎ আমার কোনদিন বেশী অসুখ করে গেল, আমি আর কথা বলতে পারছি না, তুমি এইভাবে ডাকবে,–ডাক্তার মিত্র আছেন? ডাক্তার মিত্র?…হ্যাঁ, আমি ডাক্তার মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির বাড়ি থেকে বলছি
.
মানুষ কি কোনও একটা মুহূর্তে হঠাৎ এক একটা বয়সের সীমা অতিক্রম করে? শৈশব থেকে বাল্যে, বাল্য থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে বার্ধক্যে? সীতু সহসা এই মুহূর্তে অতিক্রম করে গেল তার শৈশবকে? তাই শ্যামলীর একবারের ডাকেই উঠে দাঁড়াল, এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে, গাইড দেখে বার করল প্রার্থিত নাম, আর ভাঙা গলায় আস্তে আস্তে থেমে থেমে বলতে থাকল–ডাক্তার মিত্র আছেন? ডাক্তার মিত্র? আমি ডাক্তার মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির বাড়ি থেকে বলছি…হা..বাবা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন। এক্ষুনি আসতে হবে।
হ্যাঁ, হঠাৎ একদিন বেশি অসুখ করে গেছে মৃগাঙ্কর, কথা বলতে পারছেন না, তাই সীতু সীতু পারছে। সীতু এখন ইংরিজি শিখেছে।
.
কিন্তু সীতু কি শুধু ইংরিজিই শিখেছে?
আরও কিছু বুঝতে শেখে নি? বুঝতে শেখে নি নিজের হিংস্র নিষ্ঠুরতা? যে নিষ্ঠুরতায় এই রাজবাড়ির রাণীকে ভিখিরির সাজ সেজে পরের বাড়ি দাসত্ব করতে হচ্ছে, ওই চিরকঠিন শক্তিমান লোকটা জীর্ণ হতে হতে ক্ষয়ে যাচ্ছে, আর–আর খুকু—
খুকু!
এতক্ষণে বুঝি মনে পড়ে সীতুর খুকুর কথা, যখন জ্ঞান ফেরার পর ঔষধের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমোচ্ছেন মৃগাঙ্ক। তার শান্ত শ্বাসপ্রশ্বাসের ওঠাপড়া দেখা যাচ্ছে।
শ্যামলীর কাছে এসে দাঁড়ায় সীতু।
অস্ফুট দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলে, খুকু কোথায়?
খুকু!
শ্যামলী এত ঝঞ্ঝাটের মধ্যেও হঠাৎ হেসে ফেলে বলে, খুকু কোথায় কিরে? এই তো খুকু। চিনতে পাচ্ছিস না?
নিজের কোলের দিকে চোখ মেলে শ্যামলী বলে, কিছুতে ঘুমুতে চাইছে না। আসল কথা কাঁচা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে তো? তাই দেরী হচ্ছে।
কিন্তু এত কথা কে শোনে?
সীতু অবাক বিস্ময়ে বিস্ফারিত লোচনে তাকিয়ে থাকে শ্যামলীর ক্রোড়স্থিত জীবটার দিকে। ওইটা খুকু? ওই রোগা সিরসিরে ঢ্যাঙা ন্যাড়ামাথা, সত্যিই টিকটিকির মত মেয়েটা খুকু? ওকে তো এই এতক্ষণ ধরে শ্যামলীরই মেয়ে ভাবছিল সীতু!
সেই লাল লাল খাদা খ্যাদা আর সোনালি চুলওয়ালা খুকুটা তাহলে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে? আর তার হত্যাকারী সীতু?
ও কার খুকু?
তীক্ষ্ণ প্রশ্নে বিদীর্ণ করে ফেলতে চায় শ্যামলীকে সীতু–বল না কার খুকু?
কী মুশকিল! কার আবার, তোদেরই! সত্যি চিনতে পারছিস না?
সীতু আস্তে মাথা নাড়ে।
তা চিনতে আর পারবি কোথা থেকে। শ্যামলী আক্ষেপ করে–চেনবার কি জো আছে? এমনিই তো কতদিন দেখা নেই, তাছাড়া যা হয়েছিল।
শ্যামলী খুকুর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে সস্নেহে বলে–সবচেয়ে শক্ত টাইফয়েড। আর তার মধ্যে জ্বরের ঘোরে অবিরত শুধু মা মা বলে–হ্যাঁ, এইবার বল দিকি তোদের খবর? এতক্ষণ তো–তিনিই বা কোথায়? তুই বা কোথা থেকে?
.
মৃগাঙ্ক যখন চোখ মেললেন তখন সকাল হয়ে গেছে। চোখ মেলেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। তাহলে কি ভুল নয়? সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন তিনি?
যদি পাগল না হন, তাহলে বিশ্বাস করতে হয় তার ঘরে তারই বিছানার কাছাকাছি অতসীর খাটটায় পড়ে যে ছেলেটা অঘোরে ঘুমোচ্ছ, সে সীতু!
আর সীতুর গা ঘেঁষে, সীতুর গায়ে হাত পা বিছিয়ে অকাতরে পড়ে ঘুমোচ্ছে যে, সেটা খুকু! চুপ করে এই দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মৃগাঙ্ক। ডাকলেন না, যেন ডাক দিলেই এই অপূর্ব পবিত্রতার ছবিখানি অপবিত্র হয়ে যাবে।
তাহলে কাল ছায়ামূর্তি দেখেন নি মৃগাঙ্ক?
কিন্তু কোথা থেকে এল ও? কে ওকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করে গেল?
কিন্তু একা কেন? অতসী কোথায়?
তবে কি অতসী–তাই ছন্নছাড়া ছেলেটা পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে–কেঁপে উঠলেন মৃগাঙ্ক। ভুলে গেলেন, এই ছবিখানি নষ্ট করতে চাইছিলেন না।
ডেকে উঠলেন।
হয়তো আকস্মিকতায় একটু বেশি জোরালো হল সে ডাক।
চমকে চোখ মেলে চাইল সীতু। উঠে বসল। চোখ নামাল।
মৃগাঙ্ক মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে গম্ভীর মৃদু স্বরে উচ্চারণ করলেন, তুমি একা এসেছ?
সীতু চোখ তুলল, হ্যাঁ।
তোমার মা মারা গেছেন?
না না, ওকি! শিউরে ওঠে সীতু।
তবে?
সীতু প্রতিজ্ঞা করেছে এবার থেকে সে সভ্য হবে, ভদ্র হবে, কেউ কথা বললে উত্তর দেবে। তাই ক্ষীণস্বরে বলে, আমি এমনি একা-খুকুকে দেখতে
খুকুকে দেখতে! খুকুকে দেখতে এসেছ তুমি!
হ্যাঁ।
.
এবার আর হরসুন্দরীর বাড়ির দরজায় নয়।
শিবনাথ গাঙ্গুলীর দরজায় এসে থামে সেই মস্ত চকচকে গাড়িখানা।
কাকে চাই?