সীতু এখন ভেবে পাচ্ছে না ছোট্ট সেই পুতুলটা, যে সীতুকে দেখলেই দাদদা দা্দদা বলে ছুটে আসত, তাকে এতদিন একবারও না দেখে কি করে ছিল সীতু!
খুকুটা যদি পার্কে আসে!
সেই লাল সিল্কের ফ্রকের নীচে থেকে নেমে আসা মোট্টা মোট্টা গোল গোল পা দুখানা নিয়ে থথপিয়ে হেঁটে ছুটে আসে সীতুর দিকে। সেই নরম ফুলের বস্তাটাকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেবার দুরন্ত আকুলতাটা সীতুকে ভুলিয়ে দেয়, তার নাকি মরণবাচন অসুখ হয়েছিল, যায় যায় অবস্থা হয়েছিল!
আস্তে আস্তে দুপুরের রোদ ঢলে পড়ে। প্রায় ঢলে পড়ে সীতুও।
পেটের মধ্যে খিদেয় পাক দিচ্ছে। সামনে দিয়ে হেঁকে যাচ্ছে অবাক জলপান, ঘুগনিদানা, ঝালমুড়ি, আইসক্রীম।
ওদিকে সীতুর তাকাতে নেই।
কিন্তু যখন তাকাতে ছিল? তখন কি তাকাত সীতু? না, সীতু শুধু মুখ বিষ করে বসে থাকত বেঞ্চে। নেহাৎ চাকরদের সঙ্গে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হত তাকে পার্কে, তাই আসত।
আজ পার্কের বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে সীতুর হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা সীতু সব সময় অমন বিশ্রী হয়ে থাকত কেন? থাকে কেন? জগতে এত ছেলে আহ্লাদের সাগরে ভাসছে, কেন সীতু কেন পারে না সে সাগরে ভাসতে!
পারে না মৃগাঙ্ক ডাক্তারের উপর আক্রোশে আর বিতৃষ্ণায়? কিন্তু মৃগাঙ্ক ডাক্তার কি সত্যিই অত খারাপ? যদি অত খারাপ, তাহলে কেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সীতুকে আর সীতুর মাকে?
সীতুরা তো তাকে অপমানের চূড়ান্ত করেছে।
নিজের বাবা না হলে কি হয়? কি হয় তাকে বাবা বলে ডাকলে?
অনেকক্ষণ ধরে ভাবল সীতু।
যে বাড়িতে তারা থাকত, সে বাড়ির কর্তা বুড়োটা তো তার নিজের দাদু নয়, তবু তো সীতু তাদের বাড়ি থাকে, তাকে দাদু বলে। অতসী বলে বাবা। বুড়িটাকে বলে মা।
কিন্তু কই, তাতে তো রাগ হয় না সীতুর, অপমান বোধ করে না অতসী।
তবে কেন সীতু মৃগাঙ্কর বেলাতেই–?
সীতুই খারাপ, সীতুই যত নষ্টের মূল। সীতুর জন্যেই সীতুর মাকে রাজরাণী থেকে ঘুঁটে কুড়নি হতে হয়েছে। হরসুন্দরীর বাড়ির মতন বিচ্ছিরি বাড়িতে থাকতে হয়েছে, লোকেদের বাড়িতে ঝি হতে হয়েছে।
এ বাড়িটায় বিচ্ছিরি ঘর নয়, কিন্তু ভাল করে রেখেও কী বলে ওরা সীতুর মাকে? রাঁধুনী! রাঁধুনী! বামুনদির মত ভাবে সীতুর মাকে!
নিজের মাকে ঝি করেছে সীতু, রাঁধুনী করেছে। মৃগাঙ্ক খুব খারাপ লোক নয় তবু তাকে কষ্ট দিয়েছে, অপমান করেছে।
আর খুকুকে?
খুকুকে সীতু? খুকুকে সীতু মেরে ফেলেছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, মেরেই ফেলেছে। খুকুর মাকে কেড়ে নিয়েছে সীতু, কেড়ে নিয়েছে মায়ের কপাল জোর।
তবে মেরে ফেলা ছাড়া আর কি?
শার্টের ঝুলটা তুলে মুখে চাপা দিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠাটা রোধ করে সীতু। তারপর অনেকক্ষণের পর আস্তে আস্তে বেঞ্চ থেকে নামে।
খুকু পার্কে আসবে এ আশা আর নেই সীতুর। খুকু যেন একটা বিভীষিকার ছায়া নিয়ে ঝাপসা হয়ে আছে।
তবু
তবু সীতু
সন্ধ্যার অন্ধকারে জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেই সরু বারান্দাটা পার হয়ে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে একবার দেখে নেবে খুকুর খাটটায় কেউ শুয়ে আছে কিনা–টিকটিকির মত রোগা কাঠির মত রোগা যা হোক।
আর যদি সেখানে কিছু না থাকে?
যদি দেখে খাটটা খালি, খাটের পায়ের কাছের সেই ছোট্ট নীচু আলনাটা খালি! আলনার তলায় সাজানো নেই লাল নীল সবুজ ছোট্ট ছোট্ট জুতো, আর খাটের ধারে ঝোলানো নেই রঙিন রঙিন তোয়ালে!
কী করবে সীতু?
কী করবে তখন? কী করবে তা জানে না। আর বেশি ভাবতে পারছে না। শুধু জানে সীতুকে যেতেই হবে।
খুকুর সম্পর্কে ভয়ঙ্কর একটা দাঁতখিঁচোনো অন্ধকারের ভয় নিয়ে টিকতে পারবে না সীতু।
.
হরসুন্দরী কপালে করাঘাত করে বলেন, আগে কি করে জানব বলুন এখনও এই চত্বরে আছে তারা! পাড়ার ইস্কুলেই পড়ছে। ইস্কুলের কথা আমার মাথায় আসে নি। সেদিন যেদিন শেষ এসেছিলেন, আপনিও গেলেন, আমিও ঘুরে দেখি সামনে মূর্তিমান। তা দাঁড়ায় একদণ্ড? আপনার কথা বলতে গেলাম, কানেই নিল না, ঠিকরে চলে
স্কুলটা দেখিয়ে দিতে পারেন?
ইস্কুল তো ওই–ও রাস্তার মোড়ে। জগদীশ স্মৃতি বয়েজ ইস্কুল। কিন্তু এখন তো ইস্কুল বন্ধ, পূজোর ছুটি পড়ে গেছে।
পূজোর ছুটি পড়ে গেছে।
দারোয়ান সুদ্ধু দেশে চলে গেছে।
মাস্টারদের ঠিকানা?
সে আবার আশপাশের কে জেনে মুখস্থ করে রেখেছে?
শূন্যগাড়ি নিয়ে ফিরে আসেন মৃগাঙ্ক। ফিরে আসেন শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ির সামনে দিয়ে। যখন টেলিফোনে ওরা সীতুর অন্তর্ধান বার্তা বলাবলি করছে। যার একমিনিট পরে গাঙ্গুলীগিন্নী অতসীকে খুঁজে পান নি।
.
কিন্তু মৃগাঙ্ক কি ক্রমশ পাগল হয়ে যাচ্ছেন?
জলাতঙ্ক রোগী যেমন জলের দিকে তাকালেই লক্ষ লক্ষ কুকুরের ছায়া দেখতে পায়, মৃগাঙ্ক কি তেমনি সর্বত্র তার পরম শত্রুর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন?
নইলে এই ঘণ্টাকয়েক আগে কতটা দূরে যে মূর্তি একখানা চলন্ত গাড়িতে দেখেছিলেন, সেই মুর্তিকে কেন বসে থাকতে দেখবেন পার্কের মধ্যেকার একটা বেঞ্চে?
এও চকিত ছায়া?
দূর রাস্তা থেকে চলন্ত গাড়িতে বসে দেখা।
গাড়ি পিছিয়ে আনলেন মৃগাঙ্ক, নামতে উদ্যত হলেন, তারপর সহসাই সামলে নিলেন নিজেকে। ভ্রান্ত দৃষ্টির বিভ্রান্তিতে ভুলবেন না আর মৃগাঙ্ক।
মৃগাঙ্ক বুদ্ধিমান।
কিন্তু আশ্চর্য, সর্বত্র অতসীর ছায়া দেখছেন না মৃগাঙ্ক, দেখছেন কিনা সীতুর!