বামুনদি আর বামুনদির ছেলের জন্য এ হেন অভিনব ব্যবস্থা রীতিমত হাস্যকর বৈকি। বামুনদির মনিবগিন্নীর পাগলামীর পরাকাষ্ঠা!
সীতু কি সকলের অলক্ষ্যে কোন এক সময় এই কুৎসিত কদর্য বাড়িটা থেকে বেরিয়ে যাবে?
কিন্তু এরা কি খারাপ?
এরা কি হৃদয়হীন? তা তো নয়।
ছন্দার মার এবার মেয়ের দিক থেকে নাতনীর দিকে মন যায়, হাত বাড়িয়ে কোলে নিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু নাতনী তারস্বরে আপত্তি জানায়। অনেক ভুলিয়ে কোলে নিয়েই ভদ্রমহিলা যেন শিউরে ওঠেন, ওমা, মেয়ের সমস্ত শরীরটুকুই যে হাড়! কী মেয়ে, কী করে ফেলেছিস ছন্দা?
ছন্দা মলিনভাবে বলে, কত বড় অসুখে ভুগল তা বল? লিখেছিলাম তো সবই। একেবারে–যায় যায় অবস্থা হয়েছিল।
যায় যায় অবস্থা!
যায় যায় অবস্থা! সীতুর প্রত্যেকটি লোমকূপের মধ্যে থেকে কি ওই নতুন শেখা শব্দটা উঠছে?
যায় যায় অবস্থা!
ছন্দা তখনো বলে চলে, একদিন তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। পাড়ার সবাই আমায় বলতে লাগল, বেঁচে উঠেছে নেহাৎ তোমার কপালজোরে।
দিদিমা নাতনীর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, বোশেখ মাসে স্বপ্ন তোর ওখান থেকে বেড়িয়ে এসে তো আহ্বাদে কুটিকুটি, বলে, মা, দিদির মেয়েটা হয়েছে যেন মাখনের পুতুল! আর তেমনি হাসিখুশী ।
হাসি-খুশী ততক্ষণে সানাই বাঁশী বাজাতে সুরু করেছে।
দিদিমা বিরক্ত চিত্তে বলেন, বাবা, আমার কাছে জন্মাল, মানুষ হল, এখন আমাকে একেবারে ভুল?
ছন্দা মেয়ে কোলে নিয়ে অপ্রতিভভাবে বলে, অসুখ করে পর্যন্ত ওই রকম মেজাজী হয়ে উঠেছে। এই তো ছেলেটাকে আনলাম, তা গেলে তো ওর কাছে! কি যেন তোমার নাম থোকা? সীতু না কি? সীতানাথ না সীতারাম?
বলাবাহুল্য উত্তর পাওয়া তার ভাগ্যে ঘটে না।
ছন্দার মা বলেন, বড্ড দেখছি মুখচোরা। যাও খোকা, ওদিকে বাইরের বারান্দায় বোসোগে।
বাইরের বারান্দা! মুক্তির আহ্বান বহে আনছে কথাটা।
ছন্দার অনেকখানি সময় কেটে যায় অনেক কথায় অনেক হুল্লোড়ে। স্বপ্না এসেছে, এসেছে স্বপ্নার বর। খুশীর স্রোত বইছে।
হঠাৎ এই স্বচ্ছন্দ স্রোতে ঢিল পড়ে। ছন্দার মা এসে উদ্বিগ্ন প্রশ্ন করেন, তোর সঙ্গে যে ছেলেটি এসেছিল, কোথায় গেল বল দিকি? দেখতে পাচ্ছি না তো? গণেশকে দিয়ে খেতে ডাকতে পাঠালাম, বলছে বাইরে দাওয়ায় নেই। রাস্তায়ও নেই–
.
কিন্তু সত্যিই কি সীতু রাস্তায়ও নেই?
আছে। রাস্তাতেই আছে সীতু। নেশাচ্ছন্নের মত পথ চলেছে। তার চোখের সামনে শুধু বারেবারে ছায়া ফেলে ফেলে যাচ্ছে একটা তুলোর পুতুলের ধ্বংসাবশেষ! যায় যায় অবস্থা হয়ে যে নাকি টিকটিকির মত হয়ে গেছে!
মূর্তিটা ঠিক গড়তে পারছে না সীতু, কি রকম যেন হারিয়ে যাচ্ছে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার পিছনে একটা ভীষণদর্শন দাঁতাল জন্তু উঁকি মেরে মেরে বলছে, ওরকম হলে বেঁচে যায় শুধু মায়ের কপালজোরে, বুঝলি?
কিন্তু যার মা নেই? অবহেলায় ফেলে চলে গেছে?
সীতু কি জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠবে?
কিন্তু তারপর?
অদৃশ্য হয়ে যাবার শিকড় কই তার? কই আর কুড়িয়ে পেল সে বস্তু? তবে?
সীতু কি নীচু হবে? ছোট হবে? বলবে একবার শুধু খুকুকে—
ওরা যদি সকলে মিলে হেসে ওঠে? বামুনদি, নেপবাহাদুর, বাসনমাজা সেই ঝিটা?
সীতু কি তাহলে সোজা মাথা তুলে সেই মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? স্পষ্ট গলায় বলবে, তুমি আমাদের খুঁজতে গিয়েছিলে কেন? বলবে, খুকুর কি এখনো যায় যায় অবস্থা?
কিন্তু সেই মানুষটা যদি ভয়ঙ্কর লাল চোখে তাকায়? যদি ভারী ভারী গলায় বলে, খুকু নেই।
.
টেলিফোন ঝনঝনিয়ে ওঠে শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ি।
গিন্নী যথারীতি বলে ওঠেন, অ অতসী, দেখ তো মা কে ডাকে–
কিন্তু ততক্ষণে গিন্নীর পুত্ররত্ন কর্মভার হাতে তুলে নিয়েছেন। আর পরক্ষণ থেকেই তার কণ্ঠযন্ত্র লহরে হরে ঝঙ্কার তুলতে সুরু করেছে।
অ্যাঁ! বল কি? কতক্ষণ?…আঃ কী মুশকিল, তোমারও যেমন কাণ্ড! চেনো না জানো না, কী নেচারের ছেলে না খোঁজ করেই
ছেলে!
অতসী দরজার বাইরে আটকে যায়। তার সমস্ত ইন্দ্রিয়ের শক্তি বুঝি শ্রবণেন্দ্রিয়ে এসে ভিড় করে। কে কোথা থেকে খবর দিচ্ছে? কার ছেলের কথা বলছে? কী হয়েছে তার?
এদিকে তারযন্ত্র আর কণ্ঠযন্ত্র পাল্লা চালিয়ে যাচ্ছে….আচ্ছা আমি এখুনি যাচ্ছি। যাচ্ছিলামই কি বলছ? বিপদ? তা ইচ্ছে করে বিপদকে ডেকে আনলে সে আসবে বইকি!… কী বললে? গাড়ি চাপা? না না, অতদূর ভাববার দরকার নেই। তোমার কল্পনাশক্তি দূরপ্রসারী বটে। আমার মনে হচ্ছে এখানে পালিয়ে এসেছে।
এখানে!
তাহলে আর সন্দেহের অবকাশ নেই অতসীর, কোন ছেলের কথা হচ্ছে।
কী হল? বাসে ট্রামে চড়তে জানে না? হুঃ, কলকাতার এই সব বামুন চাকর ক্লাসের ছেলেদের তো চেনো না! ওরা সাত বছর বয়স থেকে পাকা হয়ে ওঠে। আমি বলছি অত উতলা হবার কিছু নেই। ঠিক শুনবে দিব্যি বিকশিত দন্তে বিড়ি খেতে খেতে এখানে এসে হাজির হয়েছে।..যাক আমি যাচ্ছি। তোমার যখন দায়িত্ব।
অতসী কি ছুটে গিয়ে রিসিভারটা কেড়ে নেবে ওই হৃদয়হীন লোকটার হাত থেকে? নাকি দুড়দুড়িয়ে নেমে গিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাবে রাস্তায়?
কিন্তু তারপর?
মনিবগিন্নীর বেহাইবাড়ি কোন রাস্তায় সে কথা কি জেনে নিয়েছে অতসী? ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে চরম নিষ্ঠুরতার আঘাত হেনেছে সে সেই অবোধ অভিমানী বালকচিত্তের উপর। আর কিছু করে নি। এখন অতসী ছেলে ছেলে বলে উভ্রান্ত হলে ভগবান সূকুটি করবেন না?