মৃগাঙ্ক চট করে উত্তর দিতে পারেন না, কেমন যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন অতসীর দিকে। বুঝি এতক্ষণ যা কিছু বলছিলেন, উগ্র এক নেশার ঘোরে। এখন অতসীর এই মৃদু কণ্ঠের দৃঢ়তায় ফিরে পেলেন চৈতন্য। নিজের ব্যবহারের কদর্যতার দিকে তাকিয়ে অশ্রদ্ধা এল নিজের উপর, আর আরও রাগ বাড়লো ওই হতভাগা ছেলেটার উপর, যে নাকি এই সব কিছুর হেতু।
কিন্তু কটুকথা বলারও বুঝি একটা নেশা আছে। তাই মৃগাঙ্ক মনে মনে অপ্রতিভ হলেও মুখে বলে ওঠেন, ছেলের হয়ে ওকালতি করতে আসা হল?
না, তোমার জন্যে এলাম। তোমাকে বাঁচাতে। এমন করে নিজেকে আর মেরো না তুমি। সীতুর দিকে তাকিয়ে আরও দৃঢ়কণ্ঠে বলে অতসী, যা তুই ও ঘরে যা। পড়গে যা।
সীতু অবশ্য নড়ে না, তেমনি ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে।
যা। তীব্র চীৎকার করে অতসী।
তথাপি সীতু অনড়।
যা বলছি। শুনতে পাচ্ছিস না?
সাতু যথাপূর্বং।
নিজে থেকে নড়বি না তা হলে?
আর ধৈর্য থাকে না। একটা কান ধরে টেনে ঘরের বার করে দেয় অতসী। দিয়ে এসে রাগে হাঁপাতে থাকে।
মৃগাঙ্ক একটুক্ষণ চেয়ে থেকে গম্ভীর হাস্যে বলেন, বলতে পারতাম, তোমাকে কে বাঁচাতে আসবে অতসী, কিন্তু বললাম না।
অতসীর চোখ দুটো জ্বালা করে আসে, তবু কষ্টে কঠিন হয়ে বলে, তুমি মহানুভব, তাই বললে না।
মৃগাঙ্করও কি চোখ জ্বালা করছে? তাই অন্য দিকে, খোলা জানলার দিকে তাকাচ্ছেন খোলা হাওয়ার আশায়?
সেই দিকে তাকিয়েই বলেন মৃগাঙ্ক, আমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ক্রমশ এতেই দাঁড়াচ্ছে, না অতসী–আঘাত আর প্রতিঘাত!
অতসী উত্তর দেয় না।
হয়তো দেবার ক্ষমতা থাকে না বলেই দেয় না। মৃগাঙ্কই আবার কথা বলেন, যদি আমার উপর এখনো একটু বিশ্বাস তোমার থাকে অতসী তো বলছি বিশ্বাস কর, ওকে ধমক দেবার জন্যে ডাকিনি আমি, মিষ্টি কথায় বোঝাবার জন্যেই ডেকেছিলাম। কিন্তু
আবেগে কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে মৃগাঙ্কর।
কিন্তু কি, তা কি আর জানে না অতসী? সীতুর ঔদ্ধত্য, সীতুর একগুয়েমি বরফকেও তাতিয়ে তুলতে পারে, সে তো অতসীর হাড়ে হাড়ে জানা। তবু মৃগাঙ্ক যখন বিষতিক্ত স্বরে কটুকাটব্য করে সীতুকে, সীতুর দিকে তাকিয়ে যখন মৃগাঙ্কর চোখ দিয়ে শুধু ঘৃণা আর আগুন ঝরে, তখন আর মেজাজের ঠিক রাখতে পারে না অতসী। তখন তুচ্ছ সীতুর একগুয়েমি, ঔদ্ধত্য, অবাধ্যতাগুলো তুচ্ছতার কোঠায় গিয়ে পড়ে, প্রকট হয়ে ওঠে মৃগাঙ্কর অভিব্যক্তিটাই।
আমাদের ভালোবাসার মধ্যে ও যে এতবড় একটা ভীষণ প্রাচীর হয়ে উঠবে, এ তো আমরা কখনো ভাবিনি অতসী!
ভাবলে কি করতে? অতসী তীক্ষ্ণ স্বরে বলে ওঠে, ওকে মুছে ফেলতে?
অতসী!
বজ্রগম্ভীর দৃষ্টিতে অতসীর দিকে তাকান মৃগাঙ্ক, ওই দুর্মতি ছেলেটা তোমার মতিবুদ্ধি সব নষ্ট করে দিচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য হচ্ছি, তোমার প্রভাব ওকে সুস্থ করে তুলল না, ওর প্রভাব তোমাকে নষ্ট করে ফেলতে বসল।
আমি যা ছিলাম তাই-ই আছি, সহসা ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে এতক্ষণকার রুদ্ধ আবেগ, তুমিই বদলাচ্ছ। দিন দিন বদলে যাচ্ছ।
মৃগাঙ্ক আস্তে ওর কাঁধে উপর একটা হাত রাখেন, আমিও বদলাইনি অতসী। শুধু মাঝে মাঝে কেমন ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। হয়ত বেশি পরিশ্রমের ফল এটা, হয়তো বা বয়সের দোষ।
অতসী মুখটা চেপে ধরে সেই বলিষ্ঠ হাতখানার আশ্রয়ের মধ্যে।
তখনকার মত সমস্যা মেটে। কিন্তু সে মীমাংসা তো সাময়িক।
.
বড় একটা আলুর মত ফুলে উঠল ছোট্ট কপালের কোলটুকু। পড়ে গিয়ে ককিয়ে উঠে সেই যে থেমে গিয়েছিল খুকু, আবার স্বর ফুটল অনেক কাণ্ড করে। ঠাণ্ডাজল, গরমজল, বাতাষ, ধরে ঝকানি, যত রকম প্রক্রিয়া আছে, সবগুলো করে দেখার পর আবার কেঁদে উঠল সে।
কিন্তু এমন করে পড়ল কি করে খুকু? এতগুলো চাকর-বাকরের চোখ এড়িয়ে?
না, চোখ এড়িয়ে কে বলল? চোখের সামনে দিয়েই তো।
খুকুর নিজের দাদা যদি খুকুকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়, ওরা কি করবে? মাইনে-খেগো চাকররা? সেই কথাই বলে ওঠে বামুন মেয়ে। স্পষ্টবাদিতার গুণে যে সকলের চক্ষুশূল আবার ভীতিস্থল।
সারা সংসার মাথায় করে রাখে বলেই অতসীকেও বাধ্য হয়ে হজম করতে হয় বামুন মেয়ের এই স্পষ্টবাদিতা। কাজেই বামুন মেয়ে যখন খরখর করে বলে, তা ওরা কি করবে? ওদের না হক বকুনি দিচ্ছ কেন মা, ওরা মাইনে-খেগো চাকর শুধু এই অপরাধে? তোমার নিজের ছেলেটি যে একটি খুনে, সে হিসেব তো শুনতে চাইছ না? এই তো আমার চোখের সামনেই তো–কচি বাচ্চাটা দাদদা দা্দদা করে গিয়ে যেই না হাঁটুটা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছে, ওমা ধরে–তুমি আমায় জেলেই দাও আর ফাঁসিই দাও, সত্যি কথাই কইব, বললে বিশ্বাস করবে না, ঝনাৎ করে হাঁটু আছড়ে ফেলে দিল বোনটাকে। আর লাগবি তো লাগ ধাক্কা খেলো একেবারে টেবিলের পায়ার কোণে। ওমা না বুঝে ঠেলেছিস তাই নয় তুলে ধর! তা নয়, যেই না মেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল, সেই তোমার ছেলে উধ্বশ্বাসে দৌড়ে হাওয়া! যাই বল মা, ছেলে তোমার হয় পাগল, নয় সর্বনেশে ডাকাত!
এ মন্তব্যের বিরুদ্ধে কি বলবে অতসী? কি বলবার মুখ আছে?
খুকুটা যে মরে যায়নি এই ভগবানের অশেষ দয়া। ভাবতে গিয়ে প্রাণটা আনচান করে চোখে জল এসে পড়ে। মেয়েকে বুকে চেপে ধরে মনে মনে বলে, কত দয়া তোমার ঠাকুর, কত দয়া!