.
হঠাৎ কেঁদে ওঠা ঘুমন্ত ছেলেকে ষাট ষাট করে ভোলায় অতসী, বলে, জল খাবি সীতু? গরম হচ্ছে সীতু? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস সীতু?
সীতু আর সাড়া দেয় না। শুধু মায়ের হাতটা আঁকড়ে ধরে।
অতসী স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। অস্বাভাবিক সীতুর মধ্যে কি তাহলে তীব্র কোনও মানসিক ব্যাধির সৃষ্টি হচ্ছে?
সকালবেলা মনিবগিন্নী প্রশ্ন করেন, রাত্তিরে ছেলে কেন কেঁদে উঠেছিল সীতুর মা?
অতসী ম্লান ভাবে বলে, স্বপ্ন দেখে মা!
হ্যাঁ, আর মাসীমা নয়, মা।
শ্রদ্ধার ডাক, ভালবাসার ডাক, আবার প্রভুভৃত্যের চরম মামুলি ডাক। তবু মা বলতেই হয়। মনিবগিন্নীর তাই বাসনা।
মাসীমা কেন গো? মা বলবে। আমার মেয়ে নেই। বলেছিলেন তিনি।
মেয়ে নেই তাই তো মেয়ের মতন। তাই তো অতসীরও এ এক পরম বন্ধন।
.
স্বপ্ন দেখে? মনিবগিন্নী বলেন, পেট গরম হয়েছে। একটু মৌরীমিশ্রীর জল করে খাইয়ে দিও দিকি, ঠাণ্ডা হবে।
সরল মানুষ এর চাইতে বেশি কিছু জানেন না, বোঝেনও না। সত্যিই ভারি সরল।
আজ সকালে কিন্তু তার কথাতেও একটু অসারল্যের ছোঁয়াচ লাগল। অতসীকে ডেকে বললেন, শুনেছ অতসী, আমার ব্যাটা, ব্যাটার বৌ যে দয়া করে গরীবের কুঁড়েয় পদার্পণ করতে আসছেন।
অতসী ঈষৎ বিস্মিত হয়। আনন্দের বদলে এমন সুর কেন?
তবে সে সহজভাবেই বলে, পূজোর ছুটি হয়েছে বুঝি?
হ্যাঁ তাই লিখেছিলেন বাবু! পূজোর আগেই বেরুচ্ছি, দিন পনের ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছি। তা তোমায় মিথ্যে বলব না অতসী, বউ আমার মন্দ নয়, মতি বুদ্ধি ভালই ছিল। কিন্তু কথায় আছে, সঙ্গদোষে শত গুণ নাশে। তোমার কাছে তো সব কথাই বলি–আমার ওই ছেলেটিই যেন বিলেতের সাহেব! যত ফ্যাসান, তত ফি কথায় নাকবাঁকানি! ওর সঙ্গে পড়ে বউও
অতসী শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায়। কি জানি আবার কোন ঝড় ওঠে! কে জানে এই স্তিমিত নিস্তরঙ্গতার উপর সে ঝড় কোন তরঙ্গ তুলবে! যে ছেলে বিলেতের সাহেবটি, সে কি বরদাস্ত করবে রাঁধুনী আর রাঁধুনীর ছেলের উপর তার মায়ের এই স্নেহাতিশয্য?
আর সেই বউ? সঙ্গদোষে যার শতগুণ নাশ হয়েছে? বউ-জাতীয়াকে বড় ভয় অতসীর। যদি সুরেশ্বরীর ছেলের বৌয়ের মত হয়?
কবে আসবেন?
কবে কি গো, আজই। মনিবগিন্নী স্বভাবছাড়া একটু ব্যঙ্গহাসি হাসেন, ট্রাঙ্ককলের টেলিফোন জানো? তাই করে খবর দিল যে এক্ষুনি। আমার ছেলের কোন কিছুতেই দিশিয়ানী নেই। দুদিন আগে খবর দেবে না। পথে বেরিয়ে কোন ইস্টিশন থেকে টেলিফোন করবে। বললে বলে, নিজের বাড়িতে আসব তার আবার খবর কি! কিন্তু শুনতেই ওই নিজের বাড়ি। এক মাসের ছুটি তো কুড়ি দিন শ্বশুরবাড়িতেই কাটাবে।
ছেলে বৌয়ের সম্পর্কে অনেকগুলি তথ্য পরিবেশন করে ফেলেন ভদ্রমহিলা।
.
অতসী আর কি করবে? সমস্ত রকম অবস্থার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত রাখা ছাড়া? ওঁর বৌ ছেলে যদি রাঁধুনী আর রাঁধুনীর ছেলেকে নিজেদের পাশাপাশি সহ্য করতে না পারে, যদি নীচে নামিয়ে দেয়, তাও মেনে নিতে হবে বইকি।
নীচের তলায় নামাটা তো কিছু নয়, অন্য সব চাকরবাকরদের চোখে অনেক নেমে যাওয়া এই যা! তবু তাই যেতে হবে। সেইটাই তো প্রস্তুতির সাধনা।
শুধু সীতু? বিরাট একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন।
.
কিন্তু অতসীর আশঙ্কা অমূলক।
ওরা ও রকম নয়।
অতসী দোতলায় কেন আছে, বা একতলায় কেন থাকবে না, এ নিয়ে মাথা ঘামাল না ওরা।
ট্রেন থেকে নেমেই স্নান সেরে বাপের বাড়ি যাবার জন্যে প্রস্তুত হতে হতে বৌ বলল, মা আপনার ঘরের পাশে ওই ছোট ঘরটায় কাকে যেন দেখলাম? কেউ এসেছেন নাকি?
মা বলে ওঠেন, ওটি আমার একটি কুড়নো মেয়ে বৌমা! ঈশ্বর-প্রেরিত। ঠাকুর দেশে চলে যাওয়ায় যখন অসুবিধেয় মরছি, তখন হঠাৎ একদিন
বৌ কথায় যবনিকাপাত করে বলে, ওঃ রান্নার লোক? তা দেখতে তো বেশ পরিচ্ছন্ন, নেহাৎ লো ক্লাস বলে মনে হল না।
অতসী পাশের ঘর দিয়ে যাচ্ছিল। দেয়ালটা ধরল। শুনতে পেল না তারপর আর কি কথা হল। সচেতন হল তখন, যখন বৌ ব্যস্তভাবে এদিকে যেতে যেতে অতসীকে দেখে বলে উঠল, আচ্ছা ওই ছেলেটি তোমার তো?
অতসী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
বৌ দালানে টাঙানো আরশিটার সামনে তাকিয়ে বেশবাসে দ্রুত আর একটি সমাপ্তি স্পর্শ দিতে দিতে বলল, ওকে আমার সঙ্গে আমার বাপের বাড়িতে নিয়ে যাব?
আপনার বাপের বাড়িতে! অতসী অবাক হয়। অতসী কারণ নির্ণয় করতে পারে না। অতসী দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে, ছেলেটা বড্ড লাজুক, যেতে চাইবে কি?
চাইবে না?
সভ্য তরুণী আর জোর করে না, বলে তবে থাক। গেলে একটু সুবিধে হত। ওখান থেকে বেবিকে ধরার লোকটিকে আনতে পারি নি, বেচারার অসুখ করেছে। এই ঠিক তোমার ছেলের মতই ছেলে। তাই ভাবছিলাম ওকে পেলে হয়তো–যাকগে আমার বাপের বাড়িতে তো লোজনের অভাব নেই। তবে যেত, ভাল ভাল খেত, খেলত
হঠাৎ অতসী দৃঢ়স্বরে বলে, আচ্ছা দাঁড়ান আমি বলছি।
ঘরে গিয়ে তেমনি দৃঢ় স্বরেই বলে, সীতু ওই যিনি এসেছেন, ওর সঙ্গে ওর বাপের বাড়ি যেতে হবে তোমায়।
সীতু এ আদেশের মর্ম ঠিক ধরতে পারে না, থতমত খেয়ে বলে, কেন, আমি লোকেদের বাপের বাড়িতে যেতে যাব কেন?
অতসী আরও দৃঢ়স্বরে বলে, কেন যাবে শুনবে? ওর সঙ্গে ওর ওই বাচ্চাটিকে কোলে করে বেড়াতে।
ইস! সীতু তীব্রকণ্ঠে বলে, টিকটিকির মত ওই মেয়েটাকে আমি কোলে নেব বইকি! ছুঁতেই ঘেন্না করে।