তা কি করেই বা জানবেন হরসুন্দরী যে, বলতে মাত্রই পরদিন সকালবেলাই দম্ভ দেখিয়ে চলে যাবে ছুঁড়ি! দুটো দিনও থাকবে না!
আহা-হা ইস! এই রাজার মত মানুষটা তাকে খুঁজতে এসে ফিরে যাচ্ছে।
এবারে বোঝাই যাচ্ছে, বাড়ি ছেড়ে চলে আসা নিছক রাগের ব্যাপার। যা তেজ যা রাগ! মানুষটা অতসীর কি রকম আত্মীয় সেটা জানবার দুরন্ত ইচ্ছেকে দমন করে থাকেন হরসুন্দরী। এই হোমরা-চোমরা দীর্ঘদেহ সাহেবী পোশাক পরা লোকটাকে জিগ্যেস করতে সাহস হয় না। তবু মনে মনে অনুভব করেন, হয় বড় ভাই, নয় ভাসুর। তা ছাড়া আর কি হতে পারে? ভাসুর হওয়াই সম্ভব, ভাই হলে যতই হোক চেহারায় আদল থাকত।
কোনও ঠিকানা রেখে যায় নি?
নাঃ! হরসুন্দরী ক্ষোভ প্রকাশ করেন, মানুষকে তো মনিষ্যি জ্ঞান করে না! কেমন যে একবগ্গা জেদী মেয়ে!
এক বগগা জেদী! সে কথা মৃগাঙ্কর চাইতে আর বেশি কে জানে!
ঘরটা এমন কিছু বিশাল বিস্তৃত নয় যে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখা যায় না, বলতে গেলে তো এ দেওয়ালে ও দেওয়ালে হাত ঠেকে। তবু মৃগাঙ্ক সহসা চৌকাঠের মধ্যে পা রাখলেন।
দেখতে চেষ্টা করছেন কি, দুদিন আগেও যারা এঘরে ছিল, তাদের উপস্থিতির রেশ এখন এর মধ্যে সঞ্চরণ করে ফিরছে কিনা? না, তা নয়, মৃগাঙ্ক শুধু অস্ফুট একটা শব্দে শিউরে ওঠাটা দমন করলেন।
এই ঘরে বাস করে গেছে অতসী! এই দুদিন আগে পর্যন্তও ছিল?
রাত্রে দরজা বন্ধ করলে তারের জাল ঘেরা ঘুলঘুলির মত ওই জানলাটা ছাড়া নিঃশ্বাস ফেলার দ্বিতীয় আর পথ নেই। আর সেই পথ থেকে উঠে আসছে নীচের কচা নর্দমার দুর্গন্ধবাহী বাতাস।
কিন্তু এত বিচলিত হচ্ছেন কেন মৃগাঙ্ক, সুরেশ রায়ের বাড়ি কি তিনি দেখেন নি?
তবু ব্যাকুল মৃগাঙ্ক ব্যগ্র স্বরে বললেন, যদি কোন দিন আসে, যদি আপনার সঙ্গে দেখা হয়, বলবেন, তার যে ছোট্ট বাচ্চা একটা মেয়ে আছে, তার খুব বেশি অসুখ–
মেয়ে!
কথা শেষ করতে দেন না হরসুন্দরী, চমকে উঠে গালে হাত দেন, মেয়ে! বলেন কি বাবা? মেয়ে আছে তার? আপনি যে তাজ্জব করলেন আমাকে! ছেলের থেকে ছোট মেয়ে? সেই মেয়ে ছেড়ে
মৃগাঙ্ক বোধ করি এবার সচেতন হন। মৃদু গম্ভীর স্বরে শুধু বললেন, হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য শিশু! যাক যদি কোনরকম যোগাযোগ–আচ্ছা–একদম একা গেছে? না কোনও
না বাবা, কেউ না। একেবারে একা। মায়ে ছেলে দুজনে চলে গেল একটা রিকশ ডেকে। তাই সে রিকশর ভাড়াটাই যে কি করে দেবে ভগবান জানেন! ঘরে তো ভাঁড়ে মা ভবানী! আপনাদের মতন এমন সব আত্মীয় থাকতে
মৃগাঙ্ক ততক্ষণে উঠোনে নেমেছেন।
না, মৃগাঙ্কর পক্ষে সম্ভব নয় নিজেকে এর থেকে বেশি ব্যক্ত করা, যতই ব্যাকুল হয়ে উঠুক অন্তর।
আশ্চর্য! আশ্চর্য!
দুদিন আগে এলেন না মৃগাঙ্ক! খুকুর টাইফয়েড! খুকু প্রবল জ্বরের ঘরে মা মা করছে, এ শুনলেও হয়তো কাঠ হয়ে বসে থাকত সেই পাষাণমূর্তি! বলত, খুকুর মা তো অনেকদিন আগে মরে গেছে!
হয়তো তাই বলত!
জ্বরে আচ্ছন্ন খুকুকে নার্সের কাছে রেখে এসেছেন মৃগাঙ্ক। আর স্বেচ্ছায় এসে বসে আছে সেই মেয়েটা। যে মেয়েটা সুরেশ রায়ের ভাইঝি।
গতকাল খুকুর একটা টাল গেল। শহরের সেরা সেরা ডাক্তারের ভিড় হয়ে উঠল বাড়িতে, নার্সের উপর নার্স এল। আর সহসাই সেই সময় ওই মেয়েটা খুকুর খবর নিতে এল। পথে এ বাড়ির কোন ঝি-চাকরের সঙ্গে দেখা হয়েছে, শুনেছে খুকুর অসুখ।
ভাবলে অবাক লাগে, সেই কাল থেকে মেয়েটা মৃগাঙ্কর বাড়িতেই রয়ে গেল। নার্সের সঙ্গে মিলে মিশে দেখাশোনা করতে লাগল খুকুকে। মৃগাঙ্ক অস্বস্তি বোধ করে বারবার অনুরোধ করেছেন বাড়ি ফিরে যেতে, তার যে একটা ছোট ছেলে আছে–সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু শ্যামলী গ্রাহ্য করে নি ব্যাপারটা। বলেছে ছেলে তার যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে।
মৃগাঙ্ক অবাক হয়ে দেখলেন মেয়েটা কত সহজে সহজ হয়ে গেল। পরের বাড়ি থেকে গেল। সময়মত চান করে খেয়ে নিল, কাকাবাবু আপনি একটু বিশ্রাম করুন গে বলে জোর করে পাশের ঘরে ঘুমোত পাঠিয়ে দিল মৃগাঙ্ককে। কোথাও ঠেক খেলো না। সরল–মানে বোকা! আর বোকা বলেই হয়তো বা নিজের জীবনকে কোনদিন জটিল করে তুলবে না।
.
হয়তো মৃগাঙ্কর ভাবনাই ঠিক।
অতসী আর অতসীর ছেলের বুদ্ধি প্রখর, তাই ওরা জীবনকে ক্রমশ জটিল করে তুলছে। নইলে খেটে খাওয়া ছাড়া যার জীবনে আর কোনও গতি রইল না, সে তুচ্ছ একটু অভিমানের বশে সুরেশ্বরীর কাজটা ছেড়ে দেয়।
সে তো তবুও মোটা মাইনের সম্ভ্রম ছিল। এখন যে খাওয়া পরা রাঁধুনীর কাজ।
হ্যাঁ তাই মেনে নিতে হয়েছে। ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে আহার আর আশ্রয় জোগাড় করবার এছাড়া আর উপায় কি?
এই যে জোগাড় হয়েছে সেটাই আশ্চর্য! এমন হয় না। রিকশা করে অনেকটা দূর এগিয়ে অতসী হঠাৎ একটা গেটওয়ালা বড় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেকে বলেছিল, দাঁড়া তুই এই জিনিসপত্ৰ আগলে, আমি আসছি।
আর খানিকক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে ছেলেকে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিল, আয়।
এখানে কি? সীতু আড়ষ্ট হয়ে বলে উঠেছিল, এরা তোমার চেনা?
না! চেনা করে নিতে হবে। করে নিলাম।
অতসীর অনেক ভাগ্য যে ঠিক যে সময় বাড়ির গিন্নী রাঁধুনীহীন অবস্থায় কারে পড়ে রয়েছেন, সেই সময় অতসী গিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করেছিল, রান্নার লোক রাখবেন?