আর ঠিক এই সময় হরসুন্দরী দরজায় এসে দাঁড়াল, তার বড় মেয়েকে নিয়ে।
মহিলা দুটি ঘরের সম্পূর্ণ দৃশ্যটি একবার যাকে বলে অবলোকন করে গালে হাত দিয়ে বিস্ময় বিমুগ্ধ কণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ গা ব্যাপার কি! ও খোকা, মা পড়ে গিয়ে কাৎরাচ্ছে নাকি গো!
খোকা অবশ্য এক ডাকে কথা কয় না, এখনো কইল না।
হরসুন্দরী এগিয়ে এসে বলেন, অ সীতুর মা, কাৎরাচ্ছ কেন? কলসীটাই বা ভেঙে গড়াগড়ি যাচ্ছে কেন, মায়ে ছেলের মুখে রা নেই যে!
এবার ছেলে রা কাড়ে। স্বভাবগত তীব্র স্বরে বলে, কাৎরাবেন কেন? হাসছেন।
হাসছেন!
মা মেয়ে দুজনে বোধকরি হাঁ করে হাঁ বন্ধ করতে ভুলে যান।
কিন্তু অতসী উঠে পড়ছে না কেন? কেন উঠে পড়ে বলছে না, বোকাটার কথা শুনছেন কেন মাসীমা! হঠাৎ পেটটা বড্ড ব্যথা করছে বলে!…ওই ব্যথার দাপটেই হাত থেকে কলসীটা পড়ে গিয়ে
না, অতসী উঠছে না। মাটিতে মুখ গুঁজেই পড়ে আছে সে। শুধু দেহটা যে কেঁপে কেঁপে উঠছিল সেটা স্থির হয়ে গেছে।
হরসুন্দরী যদিও নিজের মেয়েদের সম্পর্কে সর্বদাই বিদ্বেষবাক্য উচ্চারণ করেন, কিন্তু আপাতত দেখা গেল মায়ে-ঝিয়ে একতার অভাব নেই। মেয়েও অবিকল মায়ের ভঙ্গীতে গালে হাত দিয়ে বলে, হঠাৎ এত হাসির কি কারণ ঘটল যে গড়াগড়ি দিয়ে হাসতে হচ্ছে? সিদ্ধি খেয়েছ নাকি গো অতসী?
তোমরা সব্বাই এত অসভ্য কেন? সীতু স্বর আরও তীব্র করে, কলসীতে চাল নেই, রাঁধতে হবে না বলে মা হাসছেন! সিদ্ধি! সিদ্ধি মানুষে খায়? শুধু তো দারোয়ানরা খায়।
সহসা মাতা কন্যা চুপ করে যান, এবং পরস্পর একটি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় হয়। আর মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে হরসুন্দরীর চোখে যে আলোটি ফুটে ওঠে, সেটি প্রেমেরও নয়, করুণারও নয়, স্রেফ জয়োল্লাসের।
সেই আলোঝরা চোখে বলে ওঠেন হরসুন্দরী, তোমাদের রঙ্গলীলা তোমরাই জানো। ঘরে চালের দানা নেই, মেজাজ চালে মটমট! এই অবধি বুড়ি কী খোসামোদটাই করল আমাকে! তোমাদের মতিগতি দেখে আর বলে অপমান্যি হলাম না। এতদিনে তারা হতাশ হয়ে অন্য লোক রাখল। যাক গে মরুক গে! ভেতরের কথা তোমরাই মায়ে পোয়ে জানো। আমার কথা বলে যাই। ভাড়া না নিয়ে ভাড়াটে পুষি এমন সঙ্গতি আমার নেই। মাসের আর দুদিন আছে, এর মধ্যে অন্য ব্যবস্থা করে ফেলো, পয়লা থেকে আমার মেয়ের ভাগ্নী এসে থাকবে। এর যেন আর নড়চড় না হয়।
দুম দুম করে চলে আসেন দুজনে। কিন্তু দোষ হরসুন্দরীকে দেওয়া যায় না। অসহায়া বিধবাকে দেখে মায়া তার পড়েছিল। ওদের যাতে ভাল হয় তার চেষ্টাও কম করেন নি। কিন্তু মায়া যে নেয় না, ভাল যে চায় না, তার ওপর কতক্ষণ আর কার চিত্ত প্রসন্ন থাকে?
তার উপর আজকের এই পরিস্থিতি।
বলতে এসেছিলেন অবিশ্যি বাড়ি ছাড়ারই কথা। কিন্তু রয়ে বসে আর একবার শেষ চেষ্টা দেখে বলবেন ভেবেছিলেন। ওমা এ আবার কী ঢং! ঘরে চাল নেই, রান্নার ছুটি বলে আহ্লাদে গড়াগড়ি দিয়ে হাসছে! হয় পাগল, নয় তলে তলে অন্য ব্যাপার! হয়তো আসলে গরীব নয়, ঘর ভেঙে পালিয়ে টালিয়ে এসেছে। আবার হয়তো ফিরে যাবে। তবে আর মায়া করার কী দরকার?
মেয়ে বলে, তুমি মোটেই আশা কোর না মা, যাবে। ও দেখো ঠিক ঘর কামড়ে পড়ে থাকবে।
হরসুন্দরী থমথমে গলায় বলেন, নাঃ সেদিকে তেজ টনটনে। ছেলের হাত ধরে গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াবে, তবু মচকাবে না।
.
হ্যাঁ, হরসুন্দরী বাড়িওয়ালি চিনেছিলেন অতসীকে। মানুষ চেনবার ক্ষমতা তার আছে।
এই তালাচাবিটা রইল মাসীমা, ঘরটা ধুয়ে রেখে গেলাম। বলে ভাঙা নড়বড়ে সেই তালাটা হরসুন্দরীর কাছে নামিয়ে দিয়ে একটা নমস্কারের মত করে অতসী।
হরসুন্দরী নীরস গলায় বলেন, আশ্রয় একটা জোগাড় করেছ, না তেজ করে ছেলের হাত ধরে ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াচ্ছ?
অতসী ঈষৎ হেসে বলে, আপনাদের আশীর্বাদই আশ্রয় মাসীমা, উপায় হবেই যা হোক একটা কিছু।
হরসুন্দরী নিঃশ্বাস ফেলে চাবিটা কুড়িয়ে নিয়ে বলেন, ধর্মে মতি থাক, ছেলেটা মানুষ হোক। তবে এও বলি অতসী, তোমার যত দুৰ্গতি ওই ছেলে থেকেই। ওর চেয়ে এক গণ্ডা মেয়ে থাকাও ভাল।
মেয়ে সম্পর্কে বিরক্তি-পরায়ণা হরসুন্দরী আজ এই রায় দিয়ে বসেন।
আর কি শোনবার আছে? আর কি বলবার আছে? এখন শুধু দেখতে বেরুনো পৃথিবীটা কত ছোট।
.
না, মাসপয়লায় হরসুন্দরীর মেয়ের ভাগ্নী এসে ভাড়াটে হল না তার। ওটা ছল। ঘরটা শূন্য পড়ে রইল আর দশ বিশ দিন। এ ঘরের উপযুক্ত খদ্দের আবার জোটা চাই তো?
কিন্তু পয়লা তারিখে হরসুন্দরী বাড়িওয়ালির ওপর একটা মস্ত ধাক্কা এসে লাগল। ওই সরু বাইলেনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল প্রকাণ্ড একখানা গাড়ি। আর সেই গাড়ি থেকে রাজার মত চেহারার একটা মানুষ নেমে এসে খুঁজেছিল হরসুন্দরী বাড়িওয়ালিকে।
আচ্ছা, তার সীমানা কি ওইটুকু পর্যন্তই ছিল? তাহলে হরসুন্দরী অমন করে কপালে করাঘাত করেছিলেন কেন?
এই ঘর বাবা! এই দুদিন আগেও ছিল। হঠাৎ কী মতি হল—
নিজের দুর্মতির কথাটা আর মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেন না হরসুন্দরী। সেটা মনের মধ্যে পরিপাক করে তুষের আগুনে জ্বলতে থাকেন।
কী কুকাজই করেছেন! আর দুটো দিন যদি ধৈর্য করে অপেক্ষা করতেন! তাহলে আজকের নাটকটা কতখানি জমে উঠত, একবার প্রাণভরে দেখে নিতেন।