বোকাদের মুখরতা মৃগাঙ্কর অসহ্য, তবু সেদিন ওই বোকা মেয়েটার মুখরতা অসহ্য লাগেনি। সহসা মনে হয়েছিল, জগতে এই সরল সাদাসিধে অনেক কথা-বলা লোক কিছু আছে বলেই বুঝি পৃথিবী আজও শুকিয়ে উঠে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় নি। ভেবেছিলেন, আশ্চর্য, মেয়েটার ওপর এত বিরূপই বা ছিলাম কেন!
তোমরা কোনদিন গিয়েছিলে? সসঙ্কোচে প্রশ্ন করেছিলেন মৃগাঙ্ক।
শ্যামলী মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, উপায় আছে? একেবারে কড়া দিব্যি! দেখা করব না, খোঁজ করব না, কোন সাহায্য করব না–
সাহায্য শব্দটা উচ্চারণ করে অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গিয়েছিল শ্যামলী। চলে এসেছিলেন মৃগাঙ্ক। চলে তো আসতেই হবে। নিতান্ত কাজ ব্যতীত বাইরে থাকার জো আছে কি? খুকু নামক সেই ভয়ঙ্কর মায়ার পুতুলটা আছে না বাড়িতে? সারাক্ষণ যাকে ঝি-চাকরের কাছে পড়ে থাকতে হয়। মৃগাঙ্ক এলেই যে কোথা থেকে না কোথা থেকে ছুটে এসে বাব্বা বাব্বা বলে ঝাঁপিয়ে কোলে ওঠে।
শুধু ওই বাবা ডাকেই চিরদিন সন্তুষ্ট থাকতে হবে খুকুকে! মা বলতে পাবে না! মা নেই ওর! হঠাৎ একদিন মোটর অ্যাকসিডেন্টে মা মারা গেছে ওর!
বাবাই তাই বুকের ভেতরে চেপে ধরে খুকুকে।
কিন্তু থাকে না। বেশিদিন থাকে না এই অভিমান। থাকানো যায় না।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান মৃগাঙ্ক।
শিবপুরের এক অখ্যাত গলির ধারে কাছে ঘুরে বেড়ান। একদিন নয়, অনেকদিন। কিন্তু কী যে হয়, কিছুতেই সাহস করে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে সেই বাই-লেনের ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে যেতে পারেন না। বুকটা কেমন করে ওঠে। পা কাঁপে।
যদি অতসী পরিচয় অস্বীকার করে বসে? যদি অন্য পাঁচজনের সামনে বলে ওঠে, আচ্ছা লোক তো আপনি? বলছি আপনাকে চিনি না আমি
চলে আসেন।
আবার যখন গভীর রাত্রে ঘুম থেকে জেগে ওঠা কান্নায় উদ্দাম খুকুকে কিছুতেই ভোলাতে না পেরে, কোলে নিয়ে পায়চারি করে বেড়ান, তখন মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করেন, কাল নিশ্চয়ই। কিন্তু আবার পিছিয়ে যায় মন।
এই কাল কাল করে কেটে যায় কত বিনিদ্র রাত, আর অশান্ত দিন।
তারপর সেদিন।
যেদিন খুকু
কিন্তু এমন কি হয় না? ডাক্তার হয়েও এত বেশি নার্ভাস হলেন কি করে?
হয়তো অত বেশি নার্ভাস হয়ে উঠেছিলেন বলেই খুকু…
৫. রাগে ফুঁসে প্রতিজ্ঞা
সেদিন অপদস্থ হয়ে ঘরে গিয়ে রাগে ফুঁসে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন হরসুন্দরী, রোসো! ঝেঁটিয়ে বিদেয় করছি। ওমা আমি গেলাম তোদের ভাল করতে, আর তোরা কিনা–পুঁচকে ছোঁড়াটা যেন কেউটের বাচ্ছা!
আসল কথা দুদিকে জ্বালা হল তার।
হঠাৎ অতসী কাজটা ছেড়ে আসায় সন্দেহাকুল মনে গিয়েছিলেন তল্লাস নিতে, ভেবেছিলেন খুব একটা কিছু ঘটে গেছে বোধহয়।
কিন্তু এমন আর কি!
তাঁ, বুঝলাম ভাল ঘরের মেয়ে। ছেলেটাকে মানুষ করে তোলবার জন্যে শরীর পতন করতে বসেছে, চাকর রাখা কথাটা ভাল লাগে নি। তা বলে ঝপ করে কাজটা ছেড়ে দিবি?
সুরেশ্বরী হাত ধরে কেঁদেছিলেন।
তুমি যেমন করে পারো তাকে বুঝিয়ে বাঝিয়ে নিয়ে এসো বাপু। সেবার হাতটি তার বড় ভাল। এমনটি আর পাব না। আর যে আসবে, সেই তো হবে কি না কি জাত। এমন ভাল জাতের মেয়ে
হরসুন্দরী ভেবেছিলেন, অনুরোধ উপরোধের জাল ফেলে মাছকে টেনে তুলবেন। উপরোধে ঢেঁকি গেলানো যায়, আর এ তো ছানার মণ্ডা। অভাবের জ্বালায় মান অভিমান কতক্ষণ থাকে? নিজের ওপর আস্থা ছিল হরসুন্দরীর।
বলেই এসেছিলেন সুরেশ্বরীকে, আচ্ছা আমি বুঝিয়ে বাঝিয়ে নিয়ে আসব আবার। উপরোধের মতন উপরোধ করতে জানলে ঢেঁকি গেলানো যায় লোককে, আর এ তো গিয়ে ছানার মণ্ডা। ভাল ঘরের মেয়ে তো, হঠাৎ মান অপমান বোধটা বেশি।
কিন্তু এখন তাদের কী বলবেন? উপরোধ করার স্পৃহা তো আর নেই হরসুন্দরীর।
ওই ঢেঁটা ছেলেটা তার চিত্ত বিষ করে দিয়েছে। তাই একমনে দিন গুনছেন তিনি মাসকাবারটা কবে হয়। কবে ভাড়া না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকার দায়ে ওই আঝাড়া বাঁশ দুখানাকে ঘরছাড়া করেন।
গরীবের উপকার করতে বুক বাড়িয়ে দেওয়া যায়, যদি গরীব গরীবের মত নত থাকে, গরীবের অহঙ্কার অসহ্য!
.
হরসুন্দরী মাসকাবার পর্যন্ত অপেক্ষা করে বসে আছেন, কিন্তু অতসীর যে দিন কাটে না। তার স্বল্পসঞ্চয় ভাঁড়ারের সব কিছুই তো শেষ হয়ে গেছে। কাল পর্যন্ত চালটা ছিল, আজ তাও নেই।
চাল নেই!
মৃগাঙ্ক ডাক্তারের স্ত্রী চালের শূন্য কলসীটার সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে মৃগাঙ্ক ডাক্তারের স্ত্রী কাঁদবে? না হেসে লুটিয়ে পড়বে?
কলসীটা নেড়ে নাচাতে নাচাতে এসে বলবে, ওরে সীতু কী মজা! আজ মার বেশ রান্না করতে হবে না! বেশ কেমন যত ইচ্ছে ঘুমাবো মজা করে!
হুঁ, সেই কথাই বলতে গিয়েছিল অতসী। সত্যিই কলসীটা হাতে করে গিয়েছিল।
নাচাতে নাচাতে বলেওছিল, ওরে সীতু আজ কী মজা! আজ আর রাঁধতে হবে না আমায়
কিন্তু এত হাসি যে কোথা থেকে এল অতসীর?
প্রগলভ প্রবল হাসি! সেই হাসির ধমকে মাটির কলসীটা হাত থেকে ছিটকে গড়িয়ে ভেঙেই পড়ল একদিকে। আর অতসী লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
এক ঝাঁক স্কুলের মেয়ে একত্রে থাকলে যেমন করে তুচ্ছ কথায় হেসে লুটোপুটি খায়, একা অতসী তেমনি লুটোপুটি খাবে নাকি?
এই হাসির দিকে তাকিয়ে আতঙ্কবিহ্বল একজোড়া দৃষ্টি যেন পাথর হয়ে তাকিয়ে থাকে।