মৃগাঙ্কর মধ্যে বাড়তে লাগল বিদ্বেষ, বিরক্তি, অশান্তি। অতসীর মধ্যে কাজ করতে লাগল হতাশা, অভিমান আর অপরাধ-বোধ।
তারপর এল খুকু।
আর খুকু আসার সঙ্গে সঙ্গেই মৃগাঙ্ক সীতুকে একেবারে দূরে ঠেললেন।
সীতুর প্রতি বিদ্বেষ আর বিরক্তি তার বেড়েই চলতে লাগল, কারণে অকারণে তার প্রকাশ্য অভিব্যক্তি অতসীকে মরমে মারতে লাগল।
.
খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে পড়লেন মৃগাঙ্ক। ভাবলেন এ অবস্থার একটা প্রতিকার হওয়া দরকার। নেপবাহাদুরকে ডেকে বললেন, খোকাবাবুকো বোলাও।
প্রমাদ গনলো নেপবাহাদুর।
ডাক্তার সাহাব বোলিয়েছে বললেই তো খোকাবাবু বেঁকে বসবে। তবু সেকথা তো আর ডাক্তার সাহাবের মুখের উপর বলা যায় না। অগত্যাই ভারাক্রান্তচিত্তে গিয়ে খোকাবাবুর কাছে বক্তব্য পেশ করল।
আর সঙ্গে সঙ্গে তারর আশঙ্কা অনুযায়ী উত্তর মিলল–যাব না।
তারপর চলল দুজনের বাকযুদ্ধ।
নেপবাহাদুরের বহু যুক্তিপূর্ণ বাছাই বাছাই বাণ, আর সীতুর সংক্ষিপ্ত এক একটি তীক্ষ্ণ বাণ।
শেষ পর্যন্ত নেপবাহাদুরেরই জয় হল, অবশ্য গায়ের জোরের জয়। যতই হোক আট বছরের ছেলে তো। ওর সঙ্গে পারবে কেন? পাঁজাকোলা করে নিয়ে এল সে।
শোনো, গম্ভীরভাবে বললেন মৃগাঙ্ক ডাক্তার, আমার প্রথম কথা হচ্ছে, কথার উত্তর দেবে। যা বলব শুধু আমিই বলে যাব, আর তুমি বুনো ঘোড়ার মত ঘাড় গুঁজে বসে থাকবে তা চলবে না। শুনবে একথা?
বলা বাহুল্য সীতু বুনো ঘোড়ার নীতিই অনুসরণ করে।
মৃগাঙ্ক একটু অপেক্ষা করে আরও গম্ভীরভাবে বলেন, খুকুকে এঁটো জিনিস খেতে দিতে বারণ করি, দাও কেন?
হঠাৎ সীতুর নিজেকে আলাদা একটা লোক আর খুকুটাকে বাবার মেয়ে মনে হয়। তাই বুনো ঘাড়টা ঝট করে তুলে রুক্ষভাবে বলে, আমি সেধে সেধে দিতে যাই না, ওই হ্যাংলার মতন চাইতে আসে।
মৃগাঙ্ক বিদ্রুপে মুখ কুঁচকে বলেন, ওর অনেক বুদ্ধি, ও একটা মাতব্বর, তাই ওর কথা ধরতে হবে, কেমন? হাজার বার বলিনি তোমায় বড়দের এঁটো খেলে অসুখ করে ছোটদের?
আর যখন নেপবাহাদুরের খাওয়া ভুট্টার দানা খায়? তার বেলায় দোষ হয় না? যত দোষ নন্দ ঘোষ।
মাথাটা ঝাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকায় সীতু। বাপের ভয়ে নয়, বাপের দিকে তাকাবে না বলে।
মৃগাঙ্ক অসহ্য ক্রোধে মিনিট খানেক চুপ করে থেকে তিক্তস্বরে বলেন, ই, অনেক কথা শেখা হয়েছে যে দেখছি। কেন, নেবাহাদুরের কাছেই বা খায় কেন? তুমি যদি দেখতে পাও তো তুমি বারণ কর না কেন?
বলা বাহুল্য সীতু নীরব।
মৃগাঙ্ক বুঝি ভুলে যান তার সম্মুখবর্তী প্রতিপক্ষ একটা বালকমাত্র, ভুলে যান ওর সঙ্গে সমান সমান হয়ে কথা কইলে তারই মর্যাদার হানি হবে, ওর কিছুই না। তাই সেই সমান সমান ভাবেই কথা বলেন, না, তুমি বারণ কর না। তার মানে হচ্ছে, তুমি চাও খুকুর ওই সব নোংরা খেয়ে অসুখ করুক। বল তাই চাও কিনা?
হ্যাঁ চাই-ই তো, খুব চাই।
সহসা বিদ্যুতের বেগে উত্তর দেয় সীতু, বোধ করি কথার মানে না বুঝেই। বোধ করি শুধু বাবার মুখের উপর কথা বলার সুখে।
তাই চাও? তাই চাও তুমি? মৃগাঙ্কর গলা পর্দায় পর্দায় চড়ে, তা বলবে বইকি। তোমার উপযুক্ত কথাই বলেছ। আমড়াগাছে আমড়া না ফলে কি আর ন্যাংড়া ফলবে? কিন্তু মনে রেখো, তোমার এইসব বদমাইসী সহ্য করব না আমি। ফের যদি ওরকম দেখি, উচিত শাস্তি দেবো।
বেশ, খুকুও যেন আমার দিকে না আসে।
কষ্টে চোখের জল চেপে উচ্চারণ করে সীতু এই ভয়ঙ্কর শর্তের বাক্য।
ও বটে নাকি? মৃগাঙ্ক সেই রকম ব্যঙ্গের হাসি হেসে ওঠেন, সে হাসিটা যেন সীতুর কানের পর্দাটা পুড়িয়ে দিয়ে, গায়ের চামড়াটা জুলিয়ে দিতে দিতে বাতাসে বিলীন হয়। বটে! এই সমস্ত বাড়িটা তাহলে একা তোমারই? তোমার এলাকায় ওর প্রবেশ নিষেধ?
হ্যাঁ তো। হ্যাংলা বেহায়াটা তো কাছে এলেই খেতে চাইবে।
কী, কী বললি?
মৃগাঙ্ক গর্জন করে ওঠেন, বেয়াদপ অসভ্য ছেলে! দিন দিন গুণ প্রকাশ হচ্ছে। আর যদি কোনদিন এভাবে মুখে মুখে জবাব দিতে দেখি, চাবকে লাল করব তোমায় আমি।
এ গর্জন অতসীর কাছে পর্যন্ত পৌঁছয়।
উঠে এ ঘরে ছুটে আসতে যায়। আবার কি ভেবে থেমে পড়ে। দাঁতে ঠোঁট চেপে বসে থাকে নিজের ঘরে।
কিন্তু একটা বলবান স্বাস্থ্যবান কর্তা পুরুষের ক্রোধের গর্জন কি দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বিলীন হয়ে যায়? দেওয়াল ভেদ করে ফেলে না?
ক্ষীণকণ্ঠ একটা শিশুর বুকের পাটাটা যতই বেশি হোক, আর তার বিদ্বেষের তীব্রতাটা যতই প্রখর হোক, কণ্ঠস্বরটা ক্ষীণই থাকে। পর্দায় চড়ে শুধু একটা স্বরই, দুটো দেওয়াল ভেদ করে এ ঘরে এসে আছড়ে আছড়ে পড়তে থাকে সে স্বর।
এই জন্যেই বলে, কুকুরকে লাই দিতে নেই। তোমার এই আসপদ্দার ওষুধ কি জানো? জল বিছুটি। আর এবার থেকে সেই ব্যবস্থাই করতে হবে। ছোঁবে না তুমি ওকে, বুঝলে? আঙুল দিয়ে ছোঁবে না। কী হল! আবার মুখের ওপর চোপা? হ্যাঁ তাই, শুধু তোমার হাতই লোনা। তোমার হাত গায়ে পড়লেই রোগা হয়ে যাবে খুকু। তাই ঠিক। উঃ এক ফোঁটা ছেলে, আমার জীবন বিষ করে ফেলেছ একেবারে। এই জন্যেই শাস্ত্রে বলে বটে–আগুনের শেষ, ঋণের শেষ, আর শত্রুর শেষ
না, ঘরে বসে থাকতে পারে না অতসী। ধীরে ধীরে ওঘরে গিয়ে মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলে, শাস্ত্রে কী বলে, সেটা আর পাড়া জানিয়ে নাই বা বললে?