সেদিন প্রকাশ করেছিল মৃগাঙ্ক নিজের অসহিষ্ণুতার কারণ। বলেছিল, হাতে করে বিষ খাইয়ে মারবে, এমন কথা কেউ বলে নি অতসী, কিন্তু পরোক্ষ বলেও তো একটা কথা আছে! এমনও তো হতে পারে ওর রক্তের মধ্যে বিষ লুকিয়ে আছে। যদি থাকে, সুযোগ পেলে বিষ নিজের ডিউটি পালন করবেই। আর কুষ্ঠের বিষ–
শুনে চুপ করে গিয়েছিল অতসী।
বুঝতে পেরেছিল কোথায় মৃগাঙ্কর বাধা। তারপর একটু থেমে ম্লানস্বরে বলেছিল, ওর জন্মাবার পরে তো
প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে হয়তো পরে, কিন্তু ওর জন্মের আগেই যে রোগটা জন্মায় নি, তাও জোর করে বলা যায় না অতসী! রোগ প্রকাশ হবার আগে অনেক দিন ধরে নিঃশব্দে লুকিয়ে থাকে রোগের বীজ, এ শুধু আমি ডাক্তার বলেই জানি তা নয়, সবাই জানে।
তাহলে–বলতে গলা কেঁপে গিয়েছিল অতসীর, তাহলে সীতুকে ভাল করে পরীক্ষা করছ না কেন একবার?
করেছি অতসী! তোমার মিথ্যা উৎকণ্ঠা বাড়ানোয় লাভ নেই বলে তোমাকে না জানিয়ে করেছি পরীক্ষা
পরীক্ষার ফল? আরও কেঁপে গিয়েছিল অতসীর গলা।
ফল এমন কিছু ভয়ঙ্কর নয়, কিন্তু তবুও সাবধান হবার প্রয়োজনীয়তা আছে। ছোট্ট বাচ্চারা একেবারে ফুলের মত, এতটুকুতেই ক্ষতি হতে পারে ওদের।
শুনে আর একবার বুকটা কেঁপে উঠেছিল অতসীর, আর এক আশঙ্কায়। ছোট্ট ফুলের মতটির অনিষ্টের আশঙ্কায়। সেখানেও যে মাতৃহৃদয়! মা হওয়ার কী জ্বালা!
অতসীর ক্ষেত্রে বুঝি সে জ্বালা সৃষ্টিছাড়া রকমের বেশি, এই জ্বালাতেই সমস্ত পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় পেয়েও কিছুই পেল না অতসী।
কিন্তু এমন দুঃসহ যন্ত্রণার কিছুই হত না, যদি সীতুর স্মৃতিশক্তিটা অত প্রখর না হত! যদি বা সীতু তখন আরও একটু ছোট থাকত!
ঠিক অতসীর এই চিন্তারই প্রতিধ্বনি করেন মৃগাঙ্ক ডাক্তার, হয়তো আমরা সত্যিকার সুখী হতে পারতাম অতসী, যদি সীতু তখন আরও ছোট থাকত। বলেছি তো, একটা বাচ্চা ছেলের কাছে হেরে গেছি আমরা।
অতসী দৃঢ়স্বরে বলে, আর হেরে থাকতে চাই না। সুখী হতেই হবে আমাদের। আমি যা বলছি সেই ব্যবস্থাই কর তুমি।
বললাম তো–মৃগাঙ্ক হাসেন, এত চট করে দানপত্রে সই করে বসতে নেই। যাক আরও কিছুদিন। হয়তো আর একটু বড় হলে ওর এই বন্য স্বভাবটা শোধরাবে।
হয়তো অতসী আরও কিছু বলত। হয়তো বলত, শোধরাবার ভরসাই বা কি? রক্তের মধ্যে যে উত্তরাধিকারসূত্রে শুধু রোগের বিষই প্রবাহিত হয় তা তো নয়? স্বভাবের বিষ? মেজাজের বিষ? সেগুলোও তো কাজ করে? বল তো, আর শোধরাবার উপায় নেই। সব জেনে ফেলেছে সীতু।
কিন্তু বলা হয়নি, টেলিফোনটা বেজে উঠেছিল, মৃগাঙ্কর ডাক পড়েছিল।
.
থমথম করে কাটে কয়েকটা দিন।
বাড়িটাও স্তব্ধ। মৃগাঙ্ক ডাক্তার যেন নিঃশব্দ হয়ে গেছেন।
অতসী জিদ ধরেছে সীতুকে বোর্ডিঙে ভর্তি করে না দিলে অতসীই বাড়ি ছাড়বে। মৃগাঙ্ক এর অন্য অর্থ করেছেন। ভেবেছেন অভিমান।
আশ্চর্য, পৃথিবীটা কী অকৃতজ্ঞ! যাক থাকুক বোর্ডিঙে, হয় তো সেই ভাল।
ভারি গম্ভীর হয়ে গিয়েছেন মৃগাঙ্ক। সীতুর দিকে আর তাকিয়ে দেখেন না, এমন কি স্পষ্ট একদিন দেখলেন নিজের খাওয়া দুধ থেকে খুকুকে দুধ খাওয়াচ্ছে সীতু, বোধ করি ইচ্ছে করেই মৃগাঙ্ককে দেখিয়ে দেখিয়ে, তবু একটি কথা বললেন না। মিনিট খানেক তাকিয়ে দেখে সরে গেলেন। গেলেন সীতুরই জামা জুতো কিনতে। ছেলেকে অন্যত্র রাখবার প্রস্তুতি। বড়লোকের ছেলেদের জায়গায়, বড়লোকের ছেলেদের সঙ্গেই তো থাকতে হবে মৃগাঙ্ক ডাক্তারের ছেলেকে!
কিন্তু সীতু? সীতু ক্রমশই ক্ষেপে যাচ্ছে।
মাকে যেমন করে সেদিন মেরে ধরে আঁচড়ে কামড়ে যা খুশী বলেছে, তেমনি করে মেরে আঁচড়ে কামড়ে যা খুশী বলতে ইচ্ছে হয় তার মৃগাঙ্ককে। তাই চেষ্টা করে বেড়ায় কিসে ক্ষেপে যাবেন মৃগাঙ্ক।
সেই ক্ষেপে যাবার মুহূর্তে যখন সেদিনের মত কান ঝাঁকুনি দিতে আসবেন, তখন আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে না সীতু, ঝাঁকিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে এলোপাথাড়ি ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বলবে কেন, কেন তুমি আমাকে মারতে এসেছ? কে তুমি আমার? তুমি কি আমার সত্যি বাবা? তুমি কেউ নও, একেবারে কেউ নও! তুমি মিথ্যুক! আমার বাবা মরে গেছে।
কিন্তু সে সুযোগ আর আসে না।
খুকুকে এঁটো দুধ খাওয়ানোর মত ভয়ঙ্কর কারণ ঘটিয়েও না। মৃগাঙ্ক কেবল জিনিসের উপর জিনিস আনছেন।
অতসী হতাশ হয়ে বলে, কি করছ তুমি পাগলের মতন? কত এনে জড় করছ? আট বছরের একটা ছেলে আটটা সুটকেস নিয়ে বোর্ডিঙে যাবে, ক্লাস ফোরের পড়া পড়তে? এ কী অন্যায় টাকা নষ্ট!
নষ্ট করার মত অনেক টাকা যে আমার আছে অতসী! মৃগাঙ্ক ম্লান হেসে বলেন, তাই করছি।
ওকে বাড়ি থেকে সরাতে আমার চাইতে তো দেখছি তোমার অনেক বেশি মন-কেমন করছে।
কিছু না অতসী, কিছু না। টাকা আছে, টাকা ছড়াচ্ছি, এই পর্যন্ত।
ও কথা বলে আমায় ভোলাতে পারবে না। অতসী হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে, বংশের গুণ কেউ মুছে ফেলতে পারে না। ওরা অকৃতজ্ঞের বংশ। উপকারীকে লাথি মারাই ওদের স্বভাবগত গুণ। নইলে আর সীতু তোমাকে–
মৃগাঙ্ক ডাক্তার কেমন একরকম করে তাকান, তারপর আস্তে আস্তে বলেন, আমার ওপর ওর কৃতজ্ঞ থাকবার কথা নয় অতসী, কদিন ভেবে ভেবে আমি বুঝছি এইটাই আমার ঠিক পাওনা। আমার ওপর ওর ভালবাসা হবে কেন? পশু পাখী কীট পতঙ্গও শত্রু চিনতে পারে। সেটা সহজাত। তুমি জানন না, আমি তো জানি, আমি ওর বাপকে চিকিৎসা করার নামে খেলা করেছি, ইনজেকসনের সিরিঞ্জে শুধু ডিস্টিল্ড ওয়াটার ভরে নিয়ে গিয়েছি–