হৃদয়ের দরজায় চাবি কুলুপ লাগিয়ে শান্ত সমাহিত হয়ে ঘুরে বেড়াবে।
আর মৃগাঙ্ক নিজে?
.
বলি খোকাবাবু আজ খাবে কি খাবে না?
বামুন মেয়ে এসে দাঁড়াল সীতুর পিছনে, তোমার মা বেরিয়ে গেছে, বলে গেছে তোমাকে খাইয়ে রাখতে, ফিরতে দেরি হবে।
সাধারণত বামুন মেয়ের কথা গ্রাহ্য করে না সীতু। আজও করত না, যদি না শেষদিকের কথাগুলো কানে এসে বাজত।
মা বেরিয়ে গেছে। ফিরতে রাত হবে!
কোথায় গেছে অতসী?
সীতুকে না জানিয়ে আর কবে কোনদিন কোথায় গেছে? কই মনে তো পড়ে না। হয় সীতু সঙ্গেই থাকে, নয় তাকে বলে বুঝিয়ে গল্পের বই ঘুষ দিয়ে তবে তো যায়।
আজ এটা কি?
হঠাৎ বুকটা একটু কেঁপে উঠল। সেই তখনকার কথাই কি তবে সত্যি? তখন বলেছিল না অতসী–তুমি কেন চলে যাবে, আমিই চলে যাব।
তাই কি? রাগের সময়কার সেই প্রতিজ্ঞাটাই তাহলে পালন করতে বসল মা?
চোখে জল আসতে না দেবার প্রতিজ্ঞা করে কাঠ হয়ে বসে রইল সীতু পিছন ফিরেই। তবু মান খুইয়ে জিগ্যেস করা তো চলে না, কোথায় গেছে মা।
বামুন মেয়ে আবার বলে ওঠে, এই এক কাঠগোঁয়ার এক বগা ছেলে হয়েছে বাবা! খুরে খুরে নমস্কার! এতখানি বয়েস হয়েছে আমার, এমনধারা ছেলে সাতজন্মে দেখি নি। কোন ঝাড়ের বাঁশ যে আনল! নাও বাপু নাও চল।
যাব না আমি। খাব না কিছু।
তীব্র স্বর, তীক্ষ্ণ গলা!
তবে খেও না। মা ওবাড়ি থেকে ফিরে এলে তাই বলব।
ওবাড়ি!
সেটাই বা আবার কোন রহস্য?
কিন্তু রহস্য ভেদ করতে হলেই তো ফের কথা কইতে হবে। সীতু তো কথা বলবে না।
বামুন মেয়ে বলতে বলতে যায়, আমার বলবার কথা আমি বলেছি, তা বলে তো পায়ে ধরে সাধতে পারব না। অধর্মের ভোগ আমার, তাই এখনো এ বাড়িতে পড়ে আছি। নইলে দাদাবাবু যখন ফলসুষ্ঠু গাছ ঘরে নিয়ে এল তখনই তো আমার সব ফেলে দিয়ে বেরিয়ে যাবার কথা। যেতে পারলাম না, মায়ায় পড়ে রয়ে গেলাম, এই এখন তার ফল ভুগছি। লোকের সামনে মুখ দেখাতে পারি নে, সবাই বলেছে-ছিঃ ছিঃ তোর অমন মনিবের এই কাজ! তবু রয়ে গেছি, এইবার এস্তফা দেবো, আর নয়।
অতসীর অনুপস্থিতির সুযোগে বামুন মেয়ে বেশ সশব্দেই স্বগতোক্তি করতে করতে চলে যায়। তাকিয়ে দেখে না ওই জেদি ছেলেটার ভুরু কোঁচকানো মুখেও কী হতাশ অসহায়তা ফুটে উঠেছে।
মা একেবারে চলে যায় নি, আবার তাহলে ফিরে আসবে, এ তথ্যটা যেই নিশ্চিত করেছে তাকে, সেই জেগে উঠেছে এক ক্ষুব্ধ তীব্র অভিমান সীতুর অজানায় অনেক কিছুই এখন চলছে। কোথায় কোনখানে ওবাড়ি নামক এমন একটা জায়গা আবিষ্কার হয়েছে, যেটা এবাড়ির সবাই জানে, বামুন মেয়ে পর্যন্ত জানে, কিন্তু সীতু ছন্দাংশেও জানে না। আর সবচেয়ে অসহায়তা সীতুর, কাউকে সে জিগ্যেস করতে পারবে না।
না, মরে গেলেও মুখফুটে কাউকে জিগ্যেস করতে পারবে না, মা কোথায়? কোথায় সেই ওবাড়িটা? কে থাকে সেখানে? কবে তাদের চিনল মা?
সীতু কেন মরে যায় না? সীতুর বয়সী কত ছেলেই তো মরে। এই তো সেদিন ওই সামনের বাড়ির ওই দোতলার ছেলেটা মরে গেল, কি যেন নাম ছিল তার সীতু জানে না। কিন্তু কী মোটা ছিল তা দেখেছে তো!
হঠাৎ একদিন ওবাড়িতে খুব জোর কান্না উঠল, সীতু হাঁ করে তাকিয়ে থাকল, তারপর সকলের বলাবলিতে জানতে পারল সেই ছেলেটা মারা গেছে।
ভয়ানক রকম আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সেদিন সীতু। আগের দিনও ছেলেটাকে রাস্তায় বেরতে দেখেছিল যে!
আর আজ সীতু অবাক হচ্ছে এই ভেবে যে, সীতু এত রোগা, তবু হঠাৎ ওইরকম মরে যায় না কেন? এই এক্ষুনি যদি মরে যেতে পারত! যদি মা সেই ওবাড়ি না কি থেকে এসে দেখত সীতু এই জানলার ধারে মরে পড়ে রয়েছে।
বেশ হয়, ঠিক হয়!
দুহাতে শক্ত করে জানলার গ্রীল চেপে ধরে তাতেই মাথাটা ঠেকিয়ে সীতু প্রাণপণে প্রার্থনা করতে থাকে–ভগবান এই দণ্ডে মরিয়ে দাও সীতুকে।
ধ্রুবও তো ছিল সীতুর বয়সী ছেলে, তার প্রাণপণ ডাকে তো ভগবান নিজে এসে দেখা দিয়েছিলেন, আর সীতুর ডাকে যমরাজাকে একবার একটু পাঠিয়ে দিতে পারেন না? যমরাজাই তো মরার দেবতা।
কিন্তু প্রাণপণ মানে কি? আর কাকে প্রাণপণ বলে?
৩. গাড়ি গ্যারেজে পুরে
গাড়ি গ্যারেজে পুরে মৃগাঙ্ক বাড়ি ঢুকলেন, সঙ্গে ঢুকল অতসী–পায়ে হেঁটে।
মৃগাঙ্ককে দেখে একটু কি অস্বস্তি পেল? নাকি সপ্রতিভভাবেই ঢুকল শুধু মাথার কাপড়টা আর একটু টেনে? হয়তো বা টানলও না, শুধু একেবারে নির্লিপ্ত থাকবে, তাই টানার ওই ভঙ্গীটুকু করল মৃগাঙ্কর উপস্থিতিকে সম্মান দিতে।
মৃগাঙ্ক ঈষৎ অবাক হয়ে বললেন, পায়ে হেঁটে একা কোথায়?
অতসী এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, পায়ে হেঁটে, কারণ গাড়ি চড়ার মত দূর নয়, কাউকে নিয়ে যেতে চাই না বলেই একা, আর কোথায় সে কথা শুনলে হয়তো সুখী হবে না।
সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার মত মনের মধ্যে একটা আবেগের আলোড়ন উঠে আছড়ে পড়ল।
সুখী হতে বাধা কি? সুখী হতে কি পারে না মৃগাঙ্ক?
হঠাৎ ভারি একটা ইচ্ছে হল মৃগাঙ্কর, সুখী হলে কেমন লাগে অনুভব করতে। সুখী হওয়াটা না নিজের হাতের মুঠোয়? শক্তিমানেরা না ইচ্ছে করলেই সুখী হতে পারে? তাই এতক্ষণ ভাবছিল না মৃগাঙ্ক গাড়ি চালিয়ে আসতে আসতে?
তবে একবার পরীক্ষা করে দেখতে দোষ কি?
তাই মৃগাঙ্ক ডাক্তারের কপালের চামড়া কুঁচকে উঠল না, কোঁচকালো গালের চামড়া, ঈষৎ হাসিতে। আমি কিসে সুখী হই আর কিসে হই না, সে খবর রাখো?