মৃগাঙ্ক তীব্র বিদ্রুপে বলে ওঠেন, দিয়েছেন, খুব ভালই করেছেন, কিন্তু তুমি সেটা মেনেও তো নিয়েছ দেখতে পাচ্ছি।
কী করব বল ভাই, করবার আছে কি? খুশী তাই করে ও, আর ওর বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দিতে নিজের কানে শুনেছি আমি, বাহাদুরী করে বলে বেড়ায় পুরুষমানুষ কোথায় জব্দ জানিস, কেলেঙ্কারির ভয়ের কাছে। তাই কেয়ার করি না আমি ওকে, মারতে তো পারবে না, আমাদের পিতামহী প্রপিতামহীদের আমলের মত? তবে আর ভয়টা কি? বোঝ ভাই, যে মেয়েমানুষ এমন কথা বলতে পারে, তাকে কী করা যায়?
মারাই যায়! আরও তীব্রস্বরে বলে ওঠেন মৃগাঙ্ক, আমাদের সেই চলতি কথাটা ভুলে গেছ সতীনাথ? হাতে না মেরে ভাতে মারা! তুমি ওঁর সঙ্গে সমস্ত সহযোগিতা ত্যাগ করে অপরিচিতের মত থাকতে পারো। দেখো কাকে কার আগে প্রয়োজন হয়।
সে কি আর হয়! সতীনাথ ক্ষুণ্ণভাবে বলেন, সমাজে সংসারে বাস করে তা চলে না।
না চলবার কী আছে? এ তো ঠাণ্ডা লড়াই।
ঠাণ্ডাই ডাণ্ডা হয়ে ওঠে রে ভাই! আত্মবন্ধুকে জবাবদিহি করতে হবে না? আমার পারিবারিক জীবনের ওপর সমাজের সহস্র চক্ষু তীব্র হয়ে নেই?
বেশ তো, তেমন প্রশ্ন ওঠে, স্পষ্টই বলবে স্ত্রীর সঙ্গে আমার বনে না। রায় দেওয়ার ভঙ্গীতে–কথা শেষ করে একটা সিগারেট ধরান বৃগাঙ্ক। সতীনাথ ধূমপায়ী নন, তাই একাই ধরান।
সতীনাথ মিনিট খানেক সেই অলস ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ওইখানেই তো মেরে রেখেছে ভাই। স্ত্রীর সঙ্গে আমার বনে না এতবড় লজ্জার কথা কি উচ্চারণ করা সহজ? ওর থেকে অগৌরব আর কি আছে? লোকের কাছে ওই মাথা হেঁট হবার ভয়ই এত সহ্য করতে বাধ্য করাচ্ছে। সুখ নেই, শান্তি নেই, অন্তরঙ্গতা নেই, স্টেজের থিয়েটারের মত প্রতিনিয়ত শুধু প্লে করে চলেছি।
সতীনাথের ভাষা সাদা-মাটা, কিন্তু ভাবটা মৃগাঙ্কর হৃদয়কে স্পর্শ করে। না, একেবারে উড়িয়ে দিতে তিনি পারেন না বন্ধুর মর্মকথা। এ তো একা সতীনাথের জীবনের অভিশাপ নয়। এ হচ্ছে আধুনিক সভ্যতার অভিশাপ।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলেন, এক্ষেত্রে মেয়েকে ছেড়ে থাকা তো আরোই কষ্টকর তোমার পক্ষে, মন কেমনের কথা তুলে ওকে আনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে দেখো না? তাতে তো গোলমালের আশঙ্কা নেই।
সে চেষ্টাই কি করি নি ভাই? বলল কি জানো?–অতবড় মেয়ে আমাদের মাঝখানে ঘুরে ঘুরে বেড়ালে আমার অস্বস্তি হয়, বিরক্তি আসে। আমার নিজের পেটের মেয়ে হলেও দিতাম।
তা ভাল। আশা করি এখন প্রেমের লীলাটা অবাধ চলছে? না, তোমাদের ওপর সহানুভূতি আসে না সতীনাথ, আসে ঘৃণা। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, স্ত্রী সঙ্গ ত্যাগ করবার ক্ষমতা তোমার নেই। মেরে রেখেছে আর কিছুতেই নয় সতী, ওইতেই।
বলে উঠে দাঁড়ালেন মৃগাঙ্ক। আর পরমাশ্চর্যের কথা, সতীনাথ ক্রুদ্ধ না হয়ে একান্ত ক্ষুব্ধকণ্ঠে আস্তে আস্তে বলেন, তুমি ডাক্তার মানুষ, তোমাকে আর কি বোঝাব ভাই, সবই তো বোঝ। আমাদের মতন লোকের জীবনে আর আছে কি বল? বাঁচতে তো হবে?
আর কি বলবার আছে? এরপর আর বলবার কি থাকে? দুর্বলের প্রতি ঘৃণাই বা আসবে কোথায়, আসে শুধু করুণা।
ফেরার সময় গাড়িতে সেই কথাই ভাবতে ভাবতে যান মৃগাঙ্গ, একা সতীনাথকেই বা দোষ দেওয়া যায় কোন নীতিতে? সতীনাথের চাইতে উচ্চমানের বাঁচার মানে কজনই বা আবিষ্কার করতে পারছে?
ওই যে পথের অনারণ্য, সত্যিকার সুখী আর সন্তুষ্ট মানুষ কটা আছে ওদের মধ্যে?
ওই যে মেয়েটা আর ছেলেটা–প্রায় হাত ধরাধরি করে রাস্তায় চলেছে যেন প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়ে, ওরাও হয়তো স্টেজের অভিনয় করছে।
মৃগাঙ্কর এক সমস্যা, সতীনাথের এক সমস্যা, এর ওর তার সকলেরই এক এক সমস্যা। আর অন্নবস্ত্র, ঔষধ, আচ্ছাদন, সমস্ত কিছুর চাইতে তীব্র সমস্যা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের জটিলতা।
এই পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে এক সঙ্গে থাকতেই হবে মানুষকে, ঠেসাঠেসি ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে। মরে না গেলে পৃথিবীর বাইরে কোথাও পালিয়ে যাবার উপায় নেই। থাকতে হবে রাষ্ট্রবদ্ধ হয়ে, সমাজবদ্ধ হয়ে, পরিবারবদ্ধ হয়ে, অথচ কিছুতেই কেউ কাউকে সহ্য করতে রাজী নয়।
প্রত্যেকে প্রত্যেককে বলছে, একটু সরো না বাপু।
সরবো কোথায়? সরবো কেন? এ প্রশ্ন তুললেই লেগে গেল লাঠালাঠি, বেধে গেল যুদ্ধ।
আরও সূক্ষ্মস্তরে চলে গেলে দেখবে প্রধান আসামী হচ্ছে ভুল বোঝ। একে অপরকে যেন ভুল বুঝবেই প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে।
আঃ বিধাতার সৃষ্টি এই দেহটার মধ্যে মন নামক বালাইটা যদি না থাকত! মন নামক রোগটাই মানুষকে জেরবার করছে।
এই যে মৃগাঙ্ক! কতই তো সুখী হতে পারতেন, দৃশ্যত সুখী হবার সমস্ত উপকরণই তো তার ছিল, কিন্তু হল না। জীবনবীণার তারখানি ঠিক সুরে বাজল না।
ওই ছোট্ট ছেলেটা!
সীতু।
কী অসহ্য মনোব্যাধিতেই ভুগছে ও। কী দরকার ছিল ওর এ কষ্ট পাবার? হাসত খেলতো, ছুটতো লাফাতো, যা ইচ্ছে আবদার করত, যত পারতো খেতো, কী সহজই হত! তা নয়, ও নিজের সুখকে পা দিয়ে মাড়িয়ে ক্লেদাক্ত করবে বসে বসে।
ওই তো অতসী!
হোক না আরও পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মত। ওর ওই আহ্লাদী শ্যামলীর মতই হোক না! খুব হাসুক, খুব কথা বলুক, মান করুক, অভিমান করুক, ছেলের ব্যাপার নিয়ে ঝগড়াই করুক মৃগাঙ্কর সঙ্গে, তা নয়।