আজ শুধু কথাই উঁচু নয়, গলাও উঁচু অতসীর।
তাই বা চেষ্টা করব না কেন? আমি যদি তোমার পরিচিত সমাজ থেকে নির্লিপ্ত থাকতে চাই? তোমার প্রীতিকর হবে সেই অবস্থাটা?
মৃগাঙ্ক একটু ভুরু কোঁচকালেন, তারপর ঈষৎ ব্যঙ্গে বললেন, হয়তো হবে না। তবু এটাই স্বীকার করে নেব, জীবনে সব কিছুই প্রীতিকর জোটে না।
ওঃ তাই! অতসী সহসা খুব শান্ত গলায় বলে, তাই এই নীতিতেই তাহলে সীতুকে মেনে নিয়েছিল তুমি? তোমার অগাধ অসীম উদারতায় নয়?
এবার বুঝি স্তব্ধ হবার পালা মৃগাঙ্কমোহনের।
এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে বলেন, নিজেকে আমি মস্ত এক উদার ব্যক্তি বলে কোনদিনই প্রচার করে বেড়াই নি অতসী!
ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যান মৃগাঙ্ক ডাক্তার।
আর অতসী কাঠের মত বসে থাকে সেই খাবার টেবলেরই ধারের একটা চেয়ারে। এখানে যে এখুনি চাকরবাকর এসে পড়বে, সে খেয়াল থাকে না তার।
এ কী করল সে? এ কী করল? কেঁচো খুঁড়তে, সাপ তুলে বসল?
মৃগাঙ্ককে ছোট করতে গিয়েছিল সে? ছি ছি ছি! তা করতে গিয়ে কত ছোট হয়ে গেল নিজে!
মৃগাঙ্ক স্তব্ধ হয়ে গেল।
যাবেই তো। সীমাহীন স্পর্ধা আর সীমাহীন অকৃতজ্ঞতা মানুষকে মূক করে দেওয়া ছাড়া আর কি করতে পারে?
.
ডাক্তার মৃগাঙ্কমোহনের সময় নেই অতসীর মত মন নিয়ে রোমন্থন করবার। তবু আজ আর গাড়ির স্টিয়ারিঙ নিজের হাতে নিলেন না তিনি, ড্রাইভারের হাতে ছেড়ে দিয়ে পিছনে বসলেন হেলান দিয়ে, ভাবতে লাগলেন অতসীর অভিযোগ কি ভিত্তিহীন?
সত্যি বটে, সীতুর অসভ্যতা তাকে এত পীড়িত করে যে, কিছুতেই তার প্রতি মনকে প্রসন্ন করে তুলতে পারেন না, কিন্তু ওই মেয়েটা? ওর প্রতি অপ্রসন্নতা আসতে পারে এমন কোন ব্যবহার তো ও করে নি? খুব একটা কুৎসিত কুরূপ, অমার্জিত কি অভব্য, এমনও নয়। সত্যিই অতসী যা বলেছে, সাদাসিধে সরল হাসিখুশী মেয়ে।
তবু?
তবু ওকে দেখলে বিরক্তিতে মন বিষিয়ে ওঠে যেন মৃগাঙ্কর? কেবলমাত্র সুরেশ রায়ের সম্পর্কিত বলেই তো? অতসীর দেওয়া অপবাদ কি তাহলে মিথ্যা?
অনেকবার চেষ্টা করলেন মৃগাঙ্ক সেই মেয়েটার প্রতি মনকে সহজ করেছেন এই অবস্থাটা কল্পনা করতে। ভাবলেন সহাস্যে তাকে বলছেন, খুব তো সন্দেশ খেলাম, ছেলে কেমন আছে? আর কোনও অসুবিধে নেই তো? পারলেন না, কল্পনা করতেই মনটা বিস্বাদ বোদা হয়ে উঠল।
অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ নিজের কাছে স্বীকার করলেন মৃগাঙ্ক, জীবনের এই জটিলতার জাল থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না। হতে গেলে–অতসীর ভাষায় যে অসীম অগাধ উদারতা থাকা প্রয়োজন, তা অন্তত মৃগাঙ্কর নেই।
কিন্তু কারোরই কি থাকে? এ রকম ক্ষেত্রে?
যে বস্তু অসহনীয় তাকে মন থেকে সহ্য করতে কে পারে?
সপত্নী সম্পর্কটা সহ্য করবার বস্তু নয়।
.
অনেকদিন পরে এক বন্ধুর বাড়ি গেলেন মৃগাঙ্ক।
কলেজের বন্ধু সতীনাথ।
বিশেষ করে এই বন্ধুর বাড়ি যাবার একটু তাৎপর্য আছে। বন্ধুটি কিছু বছর হল বিপত্নীকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন, ছিলেন কিছুদিন সে খাতায়। কিন্তু বছর দুই হল আবার সেখান থেকে নাম খারিজ করে নিয়েছেন, আবার সগৌরবে সস্ত্রীক বেড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, আত্মীয়জনের বাড়ির কাজকর্মে স-পরিবারে নেমন্তন্ন খেয়ে আসছেন।
দ্বিতীয়বার মস্তক মুণ্ডনের সময়ও বন্ধুবান্ধবদের নেমন্তন্ন করেছিলেন সতীনাথ, মৃগাঙ্ক ইচ্ছে করেই যান নি। অথবা যেতে ইচ্ছে হয়নি।
এতদিন বিপত্নীক অবস্থায় কাটিয়ে, বছর আড়াইয়ের মেয়েটাকে আট দশ বছরের করে তুলে, তারপর আবার বিয়ে করা, খুব খেলোমি ঠেকেছিল মৃগাঙ্কর। তদবধি বড় একটা দেখা সাক্ষাৎও হয় নি। সময় হয় নি, কর্মব্যস্ত পৃথিবীতে সভ্য শহুরে লোকগুলোর যে মরবারও সময় থাকে না।
বন্ধুর বাড়ি গিয়ে আড্ডা দেওয়া? স্বাদ ভুলে গেছে লোকে সেই পরম রমণীয়তার।
বিনা উদ্দেশ্যে বন্ধুর বাড়িতেও আর যায় না কেউ। যায় না মানে যেতে পারে না। সময় হয় না।
মৃগাঙ্ক ডাক্তার আজ বার করলেন সময়। কাজের থেকে চুরি করে নিলেন খানিকটা সময়। কিন্তু মৃগাঙ্কই কি বন্ধুর বাড়ি গেলেন বিনা উদ্দেশ্যে?
.
যদিও বন্ধুর জীবনটা মৃগাঙ্কর নিজের জীবনের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত, তবু ইচ্ছে হল মৃগাঙ্কর একবার বন্ধুর ওই বিড়ম্বনাময় জীবনটা দেখে আসেন। দেখেন তারা নিজেদেরকে কোন অবস্থায় রাখতে পেরেছে?
না, বিড়ম্বনাময় ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারলেন না মৃগাঙ্ক।
.
সতীনাথ হৈ হৈ করে ওঠেন, আরে, আরে, এসো এসো! ব্যাপারটা কি? তোমার দর্শন?
মৃগাঙ্ক ধীরে সুস্থে আসন গ্রহণ করে বললেন, দর্শনটা নিতান্তই যখন দুর্লভ হয়ে ওঠে তখন এক পক্ষকে এগিয়ে আসতেই হয়।
খুব যা হোক নিলে এত হাত? বললেন সতীনাথ, অবিশ্যি নেবার অধিকার তোমার আছে। বাস্তবিকই ভারি কুঁড়ে হয়ে গেছি, কোথাও আর যেয়ে উঠতে পারি না।
বৃদ্ধস্য তরুণী হলে যা হয়! বললেন মৃগাঙ্ক মৃদু হেসে।
যা বল ভাই। বলে নাও যত পারো। তারপর তোমার খবর কি?
ভালই! বললেন মৃগাঙ্ক।
এই নিরুত্তাপ ভালইএর পর কথাটা যেন স্রোত হারিয়ে থেমে গেল। থেমে যে গেল তার প্রমাণ পাওয়া গেল সতীনাথের পরবর্তী কথায়–কি রকম গরম পড়েছে দেখেছ?
দেখছি, খুব পড়েছে।
গরম হয়তো সত্যিই বেশি পড়েছে। কিন্তু সেটা কখনই দুই বন্ধুর আলোচ্য বিষয় হতে পারে না, যদি না তাদের কথার ভাড়ার ফাঁকা থাকে।