ওমা শোন কথা! মাথা ঘামানো আবার কি? ডাকটা কানে বাজল তাই বলেছি। দেখিনি তো ওকে কখনো এর আগে। আমি তো আজকের নই, কত কালের! তোমার শাশুড়ির আমল থেকে আছি। এদের যে যেখানে আছে সবাইকে জানি চিনি। সগর্বে ঘোষণা করে বামুনমেয়ে।
ভালই তো। বলে চলে যায় অতসী, আর মনে ভাবে, ঠিক এই কারণেই তোমাকে আগে বিদায় করা দরকার। আমার সমস্ত নিশ্চিন্ততার ওপর কাটার প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তোমায় দেব না আমি।
.
কিন্তু দেব না বললেই তো চলে না। পুরনো হয়ে দাঁড়ালে কাটাগাছেরও মাটির ওপর একটা স্বত্ব জন্মায়, শিকড়ের বন্ধন জোরালো হয়। তাকে উৎপাটিত করতে অনেক শক্তি লাগে।
কারণ তো একটা থাকা চাই! অনেক দিনের শিকড়কে উৎপাটিত করবার উপযুক্ত কারণ!
সুরেশ রায়ের ভাইঝির পরিচয় চেয়েছিল সে, এই অপরাধে বরখাস্ত করা যায়?
.
নিতান্ত বুদ্ধিসম্পন্নরাও মাঝে মাঝে বোকা হয়ে যায়, এ দৃষ্টান্ত আছে। অতসীর আজকের সেই দৃষ্টান্তে একটা নতুন সংযোজনা। নইলে কি দরকার ছিল ওর মৃগাঙ্কর সামনে শ্যামলীর আনা সেই প্রকাণ্ড মিষ্টির বাক্সটা নিয়ে আসা। খেতে বসেছিল মৃগাঙ্ক, অতসী বাক্সটা টেবিলে নামিয়ে চামচ করে সন্দেশ তুলে পাতে দিতেই মৃগাঙ্ক বলে ওঠেন, এত সন্দেশ! কেউ তত্ত্বটত্ত্ব পাঠিয়েছে নাকি?
তত্ত্ব নয়, অতসী মৃদুস্বরে বলে, শ্যামলীর ছেলের অসুখ সেরে গেছে বলে আহ্লাদ করে
শ্যামলী কে? ভুরু কুঁচকে বলে ওঠেন মৃগাঙ্ক।
শ্যামলী! অতসী থতমত খেয়ে বলে, শ্যামলী মানে সেই মেয়েটি যার ছেলের অসুখে তুমি–
থেমে গেল অতসী। দেখল মৃগাঙ্কর ভুরুটা আরও বেশি কুঁচকে উঠেছে, হাতের আঙুল কটা উঠেছে কঠিন হয়ে, সেই কঠিন আঙুলের ডগা দিয়ে সন্দেশ দুটো ঠেলে রাখছে থালার কোণে। মুহূর্তে সহসা কঠিন হয়ে উঠল অতসীও। যে স্বরে কখনো কথা বলে না সেই স্বরে বলল, খাবে না?
মৃগাঙ্ক গম্ভীর স্বরে বলেন, না।
অতসীরও বুঝি সীতুর হাওয়া লেগেছে, জেগেছে বুনো গোঁ, তা নয়তো অমন জিদের স্বরে বলে কেন, না খাবার কারণ?
ইচ্ছে নেই!
কেন ইচ্ছে নেই বলতে হবে।
বলতেই হবে?
বিদ্রুপে তিক্ত শোনাল মৃগাঙ্কর কণ্ঠ।
আশ্চর্য! এই সেদিন না মৃগাঙ্ক ডাক্তার মনকে উদার করার দীক্ষা নিচ্ছিলেন? মন্ত্রপাঠ করেছিলেন সহনশীলতার? ভাবছিলেন, অতসীর যে একটা অতীত আছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে কেন? অথচ কিছুতেই তো সামান্য ওই বাটাছানার মিহি সন্দেশ দুটো গলাধঃকরণ করতে পারলেন না! তিক্তকণ্ঠে বললেন, বলতেই হবে?
হ্যাঁ বলতেই হবে। স্বভাব বহির্ভূত জেদি সুরে রুক্ষ নির্দেশ দেয় অতসী, বলতেই হবে, বাধা কিসের? প্রতিবেশীর ঘর থেকে মিষ্টি দিলে লোকে খায় না?
প্রতিবেশী। ও হ্যাঁ, নতুন একটা পয়েন্ট আবিষ্কার করেছ দেখছি। কিন্তু প্রতিবেশীর পরিচয় বহন করেই কি সে এখানে এসেছিল?
ঠিক কথা, তা সে আসেনি। কিন্তু যে পরিচয়েই আসুক, তার অপরাধটা কোথায় জানতে পারি কি?
মৃগাঙ্কমোহনের কি সামলে যাওয়া উচিত ছিল না? ভাবা উচিত ছিল না, অতসী তো কই কখনো এমন করে না? সত্যি স্ত্রীর অধিকারে তর্কাতর্কি জেদাজেদি, অথবা ঔদ্ধত্যপ্রকাশ, এ কবে করেছে অতসী? হয় নিজেকে লুকিয়ে রাখা কুণ্ঠিত মৃদু ভাব, নয়তো বিগলিত অভিভূত কৃতজ্ঞতা। অতসীর আজকের এ রূপ নতুন, অপরিচিত। তবু তো কই নিজেকে সামলালেন না মৃগাঙ্ক, বরং যেন আগুনে ইন্ধন দিলেন। বলে উঠলেন, অপরাধ কারুর কোথাও নেই অতসী; অপরাধী আমিই। সুরেশ রায়ের আত্মীয়ের হাতের সন্দেশ খাবার রুচি আমার নেই।
স্পষ্ট স্বীকারোক্তি!
বোধকরি এতটা স্পষ্টতা আশা করে নি অতসী, তাই স্তব্ধ হয়ে গেল সে, সাদা হয়ে গেল মুখ। তারপর আস্তে আস্তে আরক্ত হয়ে উঠল সেমুখ। তারপর কথা কইল আস্তে আস্তে। বলল, এক সময় আমিও ওই নামের লোকেরই আত্মীয় ছিলাম।
মৃগাঙ্ক এবার বোধকরি একটু সামলে নিলেন নিজেকে। বললেন, বৃথা উত্তেজিত হচ্ছ কেন? কারণটা যখন সামান্য। এই সন্দেশটা খেলাম কি না খেলাম, কি এসে গেল তাতে?
প্রশ্নটা সন্দেশ খাওয়ার নয়, স্থির স্বরে বলে অতসী, প্রশ্নটা হচ্ছে রুচি না হওয়ার। প্রশ্ন হচ্ছে সহ্য করতে পারা না পারার। সাদাসিধে হাসিখুশী কমবয়সী একটা মেয়ে এক আধবার তোমার বাড়িতে বেড়াতে আসে, সেটুকু সহ্য করবার মত উদারতা তুমি খুঁজে পাচ্ছ না দেখতে পাচ্ছি।
মৃগাঙ্ক আবার যেন দপ্ করে জ্বলে ওঠেন, সেটা দেখতে পাচ্ছ অতসী, কারণ মন তোমার আচ্ছন্ন হয়ে আছে সন্দেহে আর অভিমানে। তবু জিজ্ঞেস করি, যদিই হয়ে থাকে, এই সঙ্কীর্ণতা কি খুব অস্বাভাবিক?
অন্তত যে কোনও বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে স্বাভাবিকও নয়। তুমি কি জানতে না আমার একটা অতীত আছে, আর জীবনের ছাব্বিশ সাতাশটা বছর ধরে আমি সমাজ সংসারের বাইরেও কাটাই নি? আমার সেই জীবনে কারুর ওপর একটু স্নেহ জন্মাবে না, এটাই বা হবে কেন?
মৃগাঙ্কর খাওয়া শেষ হয়েছিল, তিনি চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আমি তো বলি নি অতসী, হবে না, হওয়া উচিত নয় হওয়া অস্বাভাবিক। তুমি যাকে খুশী এবং যতখুশী স্নেহ করে বেড়াও না, আমি তো আপত্তি করতে যাচ্ছি না। শুধু এইটুকু চাইছি, আমাকে তার মধ্যে জড়াবার চেষ্টা না কর।
অতসী কি আজ ক্ষেপে গেছে? ও কি মস্তবড় একটা বোঝাঁপড়া করতে চায়–শুধু মৃগাঙ্কর সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গেও? নইলে এমন করে কথা কাটাকাটি করছে সে কি করে? এতগুলো বছরের মধ্যে যে অতসী মৃগাঙ্কর মুখের উপর একটি উঁচু কথা কয় নি?