ছেলেকে এবার আনিস একদিন। বলল অতসী, এখন তো হাঁটতে পারবে।
ও বাবা নিশ্চয়।
শ্যামলী কেন সাধারণ ভদ্রতা বা সাধারণ সৌজন্যটুকুর মানে বোবে না? কেন সেই মুখের কথাটাই বড় করে ধরে?
আজ যেন ফেরার তাড়া মাত্রও নেই শ্যামলীর, জাঁকিয়ে বসে কথা কইছে তো কইছেই।
বুঝলেন কাকীমা, আপনার জামাই বলেন, ডাক্তার কাকাবাবু শুধু ডাক্তারই নন, যাদুকরও। নইলে দেখলামও তো এ পর্যন্ত কমজনকে নয়, কেউ বুঝতে পারল না, আর উনি দেখলেন আর
মোটই ভাল ডাক্তার নয়?
হঠাৎ একটা তীব্র তীক্ষ্ণ রূঢ় মন্তব্যে শিউরে চমকে উঠল ঘরের আর দুজন। বিছানার কোণ থেকে চেঁচিয়ে উঠেছে সীতু।
.
ওমা ও কি রে সীতু, ও কথা বলতে আছে? শ্যামলী অবাক হয়ে বলে, ভাল ডাক্তার নয় কি, খুব ভাল ডাক্তার তো!
ছাই ভাল! বিদ্বেষে তিক্ত শিশুর কণ্ঠ কি কুৎসিত! ভাবল অতসী।
আর শ্যামলী ভাবল ছেলেমানুষের ছেলেমানুষী। নিশ্চয় কোন কারণে বাপের ওপর রাগ হয়েছে ছেলের। পরক্ষণেই ভাবল–তা বাপ ছাড়া আর কি! উপকারী আর স্নেহশীল মানুষকে পিতৃতুল্যই বলা হয় বইকি। ইনি যদি এমন উদারচিত্ত না হতেন, কোথায় আজ দাঁড়াত অতসী? কে জানে কোথায় ভেসে যেত সীতু!
ও বাড়ির ছোটকাকার কী না কী অবস্থা ছিল, শ্যামলী তো আর ভুলে যায় নি! কী হালে কাটিয়েছে অতসী আর সীতু, তাও দেখেছে সে।
আর এখন?
এই রাজপুরীর কুমার হয়ে সুখের সাগরে গা ভাসিয়ে থাকা! কত ভাগ্য! এ বাড়ির সাজসজ্জা আরাম আয়োজন ঔজ্জ্বল্য চাকচিক্য শ্যামলীকে মুগ্ধ করে।
বাড়িতে বরের সঙ্গে আলোচনাও করে খুব। মৃগাঙ্ক যদি এমন মহৎ না হতেন, মৃগাঙ্ক যদি এমন ধর্মনিষ্ঠ না হতেন, কী হত অতসীর দশা?
সুরেশের মৃত্যুর পর অতসীর প্রতি মৃগাঙ্কর যে ভাব জেগেছিল, সে কি শুধুই নারীরূপের মোহ? শুধুই বেওয়ারিশ একটা মানুষের প্রতি উছুল লুব্ধতা?
তা যদি হত, বিবাহের সম্মান দিয়ে তাকে ঘরে নিয়ে আসতেন? কী দরকার ছিল? তা না দিয়েও, ঘরে ঢোকার অধিকার না দিয়েও সেই মালিকহীন রূপবতাঁকে উপভোগ করবার বাধাটা কোথায় ছিল, যদি অভাবগ্রস্ত এবং মোহগ্রস্ত অতসী আত্মসমর্পণ করে বসত?
বাধা সমাজও দিত না, আইনও দিত না। পুরুষের এ দুর্বলতা গ্রাহের চক্ষেই আনত না কেউ।
অতসীকে? তা হয়তো সবাই ছিছিক্কার করত, কিন্তু তাছাড়া আর তো কিছু করত না! মৃগাঙ্ক না দেখলে সুরেশ রায়ের আত্মীয় সমাজ ডেকে শুধোত কি তাকে, হ্যাঁ গো এখন তোমার কিভাবে চলবে? বলতে কি সীতুকে মানুষ করে তুলবে কি করে?
ভাড়া দিতে না পারলে বাড়িওলা যদি তাড়িয়ে দিত? সীতুর হাত ধরে অতসী কারও বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে সে কি দরজা খুলে ধরতে?
না, মানবিকতার প্রশ্ন নিয়ে কেউ এগিয়ে আসত না। নেহাৎ যদি অতসী মান অপমানের মাথা খেয়ে কারুর পায়ে গিয়ে কেঁদে পড়ত, চক্ষুলজ্জার দায়ে সে হয়তো দিত এতটুকু ঠাই, একমুঠো ভাত, কিন্তু প্রতিদিন দীর্ঘশ্বাস আর চোখের জলে সে অন্নের ঋণ শোধ করতে হত।
নিষ্পরের বাড়ির দাসত্বে মাইনে আছে, মর্যাদা আছে। আত্মীয়জনের বাড়ির দাসত্বে দুটোর একটাও নেই। উল্টে আছে গঞ্জনা, লাঞ্ছনা, অবমাননা!
দুঃখে পড়ে আত্মীয়ের কাছে আশ্রয় নেওয়ার চাইতে বড় দুঃখ বোধকরি জগতে দ্বিতীয় নেই।
বেশ করেছে অতসী, ঠিক করেছে।
.
দুজনেই বলেছিল ওরা-শ্যামলী আর শ্যামলীর বর, ঠিক করেছেন কাকীমা।
বলেছিল, ছেলেটাকে পথের ভিখিরি হবার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন উনি।
তাছাড়া ভালবাসারও একটা মর্যাদা দিতে হয় বইকি বলেছিল শ্যামলী। ইনি, মানে ডাক্তারবাবু, কাকীমাকে সত্যিকার স্নেহের চক্ষে, ভালবাসার চক্ষে দেখেছিলেন।
তা তো সত্যি বলেছিল তার বর, নইলে আর বিবাহের মর্যাদা দেন! আরও বলেছিল, সে সীতুকে উপলক্ষ্য করে-লাকী বয়! ধর, তোমার কাকীমার যদি শুধু ওই মেয়েই থাকে, আর ছেলে না হয়, ওই অত সম্পত্তি, সব কিছুর মালিক তোমাদের সীতু। আর হয়ও যদি, বেশ কিছু তো পাবেই।
.
কাজেই লাকী বয় সম্পর্কে নিশ্চিন্তচিত্ত শ্যামলী সীতুর এই সহসা উগ্র হয়ে ওঠা রূঢ়তায় বিস্মিত না হয়ে হেসে উঠে বলে, কি হল? হঠাৎ এত রাগ কিসের সীতুবাবুর?
আশ্চর্য! আশ্চর্য!
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে সীতু, অতসীর অবিচলিত অম্লান মুখ থেকে সহসা উত্তর উচ্চারিত হচ্ছে, আরে দেখ না, ওর পেটব্যথা করছে, ওষুধ খেয়ে কমে নি, তাই অত মেজাজ! সেই থেকে পড়ে পড়ে ছটফট করছিল
ওমা তাই বুঝি! হি হি করে হেসে ওঠে শ্যামলী, সত্যিই তো বাপু, মেজাজ তো হতেই পারে। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা!
মায়ের ওই অবিচলিত মুখের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় বলেই কি সীতু আর কথা বলতে পারে না?
.
মেয়েটি কে গো বৌদিদি?
বামুন মেয়ের উগ্র কৌতূহল আর বাঁধ মানে না, মনিবানীর ভূভঙ্গীর ভয়েও না। সে কৌতূহল উক্ত প্রশ্নের আকারে এসে আছড়ে পড়ে অতসীর কাছে।
অতসী ভ্রূভঙ্গী করে।
বলে, কোন মেয়েটি?
ওই যে কেবলই আসে যায়, দাদাবাবুকে অসুখ ছেলে এনে দেখায়, এই তো আজও এসেছিল—।
আমার ভাইঝি।
গম্ভীর কণ্ঠে বলে অতসী।
ভাইঝি! বামুন মেয়ের বিস্ময় যেন আকাশে ওঠে। ভাইঝি যদি তো, তোমায় কাকীমা বলে কেন গো?
বলে, ওর বলতে ভাল লাগে। অতসী কঠিন মুখে বলে, কে কাকে কি বলে ডাকে, তা নিয়ে তোমার এত মাথা ঘামানোর কি আছে?