বলছি তো আমি এক্ষুনি চলে যাব।
যা তবে। কোন চুলোয় তোর সেই পূর্বজন্মের বাড়ি আছে, যা সেখানে। হবেই তো, এর চাইতে ভাল বুদ্ধি আর হবে কোথা থেকে? কৃতজ্ঞতা কি তোদের হাড়ে থাকতে আছে? বলছি যত শীগগির পারি তোমায় বোর্ডিঙে দেব, আজ এক্ষুনি সেটা শুধু সম্ভব নয়। একটা দিন আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
তুমি কেন মিথ্যে কথা বলেছিলে? কেন বলেছিলে ওটা আমার বাবা?
বেশ করেছি বলেছি। একফোঁটা একটা ছেলের কাছে আর হারতে পারে না অতসী। নিষ্ঠুরতার চরম করবে সে। তাই ঝজালো গলায় তেতো স্বরে বলে ওঠে, কি করবি তুই আমার? এখানে যদি না আসতিস, খেতে পেতিস না, পরতে পেতিস না, বাড়িওলা দূর দূর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিত, রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করতে হত বুঝলি? যে মানুষটা এত যত্ন করে মাথায় করে নিয়ে এল, তাকে তুই–উঃ এই জন্যেই বলে দুধকলা দিয়ে সাপ পুষতে নেই!
মেরে ফেল, মেলে ফেল আমাকে!
মেরে তোকে ফেলব কেন, নিজেকেই ফেলব। অতসী গম্ভীরভাবে বলে, সেইটাই হবে তোর উপযুক্ত শাস্তি।
.
কাকীমা!
দরজার বাইরে থেকে ধ্বনিত হল এই পরিচিত কণ্ঠটি। হল বেশ শান্তকোমল স্বরেই, কিন্তু সে স্বর অতসীর শুধু কানেই নয়, বুকের মধ্যে পর্যন্ত ঝনাৎ করে গিয়ে লাগল। লাগার সঙ্গে সঙ্গে হাত পা শিথিল হয়ে এল তার।
এ কী! এ কী বিপদ! বেড়াতে আসার আর সময় পেল না শ্যামলী? এই যে ছেলেটা খাটের ওপর মুখ গুঁজে গড়াগড়ি খাচ্ছে, এ দৃশ্য তো শ্যামলী এখনি এসে দেখে ফেলবে। কী কৈফিয়ৎ দেবে অতসী তার? শ্যামলী কি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে না? ভাববে না কি কোথাও কোনও ঘাটতি ঘটেছে? তাছাড়া সীতু ওকে দেখে আরও গোঁয়ার্তুমি, আরও বুনোমি করবে কিনা, কে বলতে পারে? হয়তো ইচ্ছে করে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করবে, যে অবস্থাকে কিছুতেই আয়ত্তে এনে সভ্য চেহারা দেওয়া যাবে না।
কাকীমা আসছি। পর্দায় হাত লাগিয়েছে শ্যামলী। মুহূর্তে সমস্ত ঝড় সংহত করে নিয়ে সহজ স্বাভাবিক গলায় কথা বলে ওঠে অতসী, আয় আয়, বাইরে থেকে ডেকে পারমিশান নিয়ে এত ফ্যাশান শিখলি কবে থেকে?
শ্যামলী একমুখ হাসি আর বড় একবাক্স সন্দেশ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
নিজের খুশীর ছটায় পারিপার্শ্বিকের দিকে দৃষ্টি পড়ে না শ্যামলীর, এগিয়ে এসে সন্দেশটা অতসীর দিকে বাড়িয়ে ধরে, নিন–বাটুর সেরে ওঠার মিষ্টি খান।
কি আশ্চর্য! এসব কি শ্যামলী? না না, এ ভারি অন্যায়।
অন্যায় মানে! অতদিন ধরে ভুগছিল ছেলেটা, আমরা তো হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কোনও ডাক্তার রোগ ধরতে পারছিল না। ডাক্তার কাকাবাবুর দুদিনের দেখায় সেরে উঠল, এ আহ্বাদের কি শেষ আছে? নেহাৎ নাকি ফুলচন্দন দিয়ে পূজো করা চলে না, তাই কাকাবাবুকে একটু মিষ্টি মুখ করিয়ে
ভারি বাক্যবাগীশ মেয়েটা। কিন্তু দ্বিধা চিন্তা কিছু নেই, সাদাসিধে সরল। কথা যখন বলে, তাকিয়ে দেখে না তার প্রতিক্রিয়া কি হচ্ছে। এই জন্যেই তো সুরেশ রায়ের বংশের মধ্যে এই মেয়েটাকেই বিশেষ একটু স্নেহের চক্ষে দেখত অতসী। সুরেশ রায়ের জেঠতুতো দাদার মেয়ে। শ্যামলা রং, হাসিখুশী মুখ, গোলগাল গড়ন, বছর আষ্টেকের মেয়েটা, বিয়ের কনে অতসীর সামনে এসে দাঁড়ানো মাত্রই অতসীর মন হরণ করে নিয়েছিল। শ্যামলীও কাকীমার মধ্যে যেন বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য দেখতে পেয়েছিল।
তারপর তো অতসীর দিকে কত ঝড়, কত বন্যা, মহামারী দুর্ভিক্ষ, আরও কত কি! আর শ্যামলীর দিকে প্রকৃতির অকৃপণ করুণা। স্কুলের পড়া সাঙ্গ হতে না হতেই ভাগ্যে জুটে গেছে দিব্যি খাসা বর, সংসার করছে মনের সুখে স্বাধীনতার আরাম নিয়ে। বড়লোক না হলেও অবস্থা ভাল, আর স্বামীটির প্রকৃতি অতীব ভাল। সরল, হাস্যমুখ। দুটো ছেলেমানুষে মিলে যেন খেলার সংসার পেতেছে!
বিধাতার আশ্চর্য নির্বন্ধ, সে সংসার পেতেছে অতসীরই বাড়ীর কখানা বাড়ি পরে। আগে জানত না দুজনের একজনও, দেখা হয়ে গেল দৈবাৎ।
পাড়ার বইয়ের দোকানে সীতুকে নিয়ে তার নতুন ক্লাসের বই কিনতে গিয়েছিল অতসী, আর শ্যামলীও এসেছে ছোট ছেলের জন্যে রঙিন ছবির বই কিনতে। অসুস্থ ছেলে রেখে এসেছে ঘরে, তার মন ভোলাতে বাছাই করছে নানা রঙবেরঙের ছবি-ছড়া। ছেলে নিয়ে দোকানে উঠেই অতসী যেন পাথর হয়ে গেল!
এ কী অভাবিত বিপদ! এই দণ্ডে কি সীতুকে টেনে নিয়ে দোকান থেকে নেমে যাবে অতসী? নাকি না দেখার ভান করবে?
দুটোর কোনোটাই হল না, চোখাচোখি হয়ে গেছে। আর চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্যামলী লাফিয়ে উঠেছে, কাকীমা!
এরপর আর কি করে না দেখার ভান করবে অতসী? কি করে চট করে নেমে যাবে দোকান থেকে?
ফিকে হাসি হাসতেই হয়, মুখে কথা জোগাবার আগে। কিন্তু শ্যামলী ওসব ফিকে ঘোরালোর ধার ধারে না। পূর্বাপর ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি, কোনও কিছুই তার উল্লাসকে রোধ করতে পারে না। দোকানের মাঝখানেই একে ওকে পাশ কাটিয়ে অতসীর গায়ে হাত ঠেকিয়ে বলে ওঠে, ওঃ কাকীমা, কতদিন পরে! বাবাঃ!
অতসীর প্রবল শক্তি আছে ঝড়কে মনের মধ্যে বহন করে বাইরে সহজ হবার, তবু বুঝি অবিচলিত থাকা সম্ভব হয় না। তবু বুঝি কথা কইতে ঠোঁট কাঁপে, তুমি এখানে!
ওরে বাবা, আমাকে আবার তুমি! এই দুষ্টু মেয়েটাকে বুঝি ভুলেই গেছেন কাকীমা? ওসব চলবে না, তুই বলুন!