হতাশ হচ্ছেন মৃগাঙ্ক, নিজের মনের চেহারা দেখে হতাশ হচ্ছেন। এমন করে তলিয়ে নিজেকে দেখা বুঝি কখনো হয় নি।
নইলে অনেক আগেই বুঝতে পারতেন, সেই রোগা হ্যাংলা কাঠিসার ছেলেটাকে কোনোদিনই সহ্য করতে পারেন নি তিনি। অবিরতই তাকে প্রতিদ্বন্দ্বীর মত মনে হয়েছে।
হোক সে অতসীর সন্তান, তবু তাকে মৃগাঙ্কর প্রতিদ্বন্দ্বী বললে ভুল হবে না। সে যে সুরেশ রায়েরও সন্তান, সে কথা বিস্মৃত হওয়া যাবে কি করে? সুরেশের সন্তান বলে কি অতসী ওকে এতটুকু কম ভালবেসেছে কোনোদিন? বুঝিবা-মৃগাঙ্ক একটু থামলেন, তারপর আবার ভাবনাটাকে এগিয়ে দিলেন বুঝিবা মৃগাঙ্কর সন্তানের চাইতে বেশিই ভালবাসে। হ্যাঁ বেশিই। মুখে যতই ঔদাসীন্য অবহেলা দেখাক, সীতুর দিকে তাকিয়ে দেখতে চোখে সুধা ঝরে ওর।
সেই সেটাই অসহ্য মৃগাঙ্কর। সেই সুধাঝরা দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিস্নাত জীবটাও তাই অসহ্য! ওকে অতসীর কাছাকাছি দেখলেই মনে পড়ে যায়, সেই কদর্য কুৎসিত রোগগ্রস্ত লোকটাকে। মনে হয় তাকে কিছুতেই মুছে ফেলা যাবে না অতসীর জীবন থেকে।
তবু এখন আর এক দিক থেকে ভাবছেন মৃগাঙ্ক। তিনি যদি সেই শীর্ণ অপুষ্ট নিতান্ত অসহায় শিশুটাকে বিদ্বেষের মনোভাব নিয়ে না দেখতেন, যদি অতসীর সামনে সস্নেহ ব্যবহার করে, আর অতসীর আড়ালে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে না তাকাতেন ওর দিকে, তাহলে হয়তো ছেলেটাও এত হিংস্র হয়ে উঠত না। এত জাতক্রোধের ভাব থাকত না তার উপর।
কিংবা কে জানে থাকত হয়ত। তার সহজাত সংস্কারই জাতক্রোধের মূর্তিতে ভিতর থেকে ঠেলা মারত তাকে। সেই সংস্কারই তাকেও শেখাতো মৃগাঙ্ক ডাক্তারকে প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখে দেখতে। ইতর প্রাণীরা তো আপন জন্মদাতাকেও তাই দেখে।
তবু আজ সত্যই অনুতপ্ত মৃগাঙ্ক ডাক্তার। সত্যই তার ভাবতে লজ্জা হচ্ছে যে ভিতরের সমস্ত গলদ প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
অতসীকে কি তিনি আর সম্পূর্ণ করে পাবেন? তার মনের দরজা কি চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে গেল না?
.
কিন্তু অতসীর সম্পূর্ণ মনটা কি তিনি কোনদিনই পেয়েছেন? পাওয়া যায় কি?
কুমারী মেয়ের মন কোথায় পাবে, সংসারে পোড়খাওয়া একখানা পুরনো মন?
পুরনো জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা ছিল অতসীর, কিন্তু সেই আগেকার আত্মীয়-স্বজনের উপর তোকই বিতৃষ্ণা নেই। ওই যে একটা মেয়ে মাঝে মাঝে আসে, অতসীকে কাকীমা কাকীমা বলে বিগলিত হয়। ও কি মৃগাঙ্কর ভাইঝি?
তা তো নয়। ওকে মৃগাঙ্ক চেনেনও না। ও সেই সুরেশ রায়ের ভাইঝি। সে এলে অতসীর মুখে যেন একটা নতুন লাবণ্যের আলো ফুটে ওঠে, তাকে আদরযত্ন করে খাওয়াবার চেষ্টায় তৎপর হয়ে ওঠে।
দেখে অবশ্য খুব ভাল লাগে না মৃগাঙ্কর, তবু বলেনও না কিছু। হঠাৎ একদিন, এই সেদিন, মেয়েটা না বলা না কওয়া দুম করে মৃগাঙ্ক ডাক্তারের ঘরে ঢুকে কাকাবাবু বলে ঢিপ করে এক প্রণাম। শিউরে উঠেছিলেন মৃগাঙ্ক।
মেয়েটা কিন্তু বেজায় সপ্রতিভ। তবে হৈ চৈ করে যতই সে মৃগাঙ্ককে কাকাবাবু, কাকাবাবু করুক, মৃগাঙ্ক তো কিছুতেই পারলেন না তাকে সস্নেহে স্বচ্ছন্দে আত্মীয় বলে মেনে নিতে! বাচ্চা একটা ছেলের চিকিৎসার জন্যে অনুরোধ করল সে মৃগাঙ্ককে, আড়ষ্টভাবে দেখে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন মৃগাঙ্ক, এই পর্যন্ত।
কেন আড়ষ্ট হলেন তিনি?
ভাবলেন মৃগাঙ্ক। অতসীর যে একটা অতীত ছিল এটা তো স্বীকার করে নিয়েই অতসীকে ঘরে এনেছিলেন, তবে কেন সম্পূর্ণ স্বীকার করে নিতে পারেন না।
মেয়েরা ঈর্ষাপরায়ণ, মেয়েরা সপত্নী-অসহিষ্ণু, মেয়েরা কৈকেয়ীর জাত, কিন্তু পুরুষের উদারতার সোনাটুকু কি কোনোদিন বাস্তব আঘাতের কষ্টিপাথরে ফেলে যাচাই করে দেখা হয়েছে?
এই তো, যাচাই করতে বসলে তো সব সোনাই রাং। মন থেকে প্রসন্ন হয়ে যদি সুরেশ রায়ের ভাইঝিকে গ্রহণ করতে পারতেন মৃগাঙ্ক, যদি পারতেন সুরেশ রায়ের সন্তানকে একেবারে নিতান্ত স্নেহের পাত্র বলে গ্রহণ করতে, তবেই না বলা যেত–পুরুষ মহৎ, পুরুষ উদার, পুরুষ স্ত্রীলোকের মত ঈর্ষাপরায়ণ ক্ষুদ্রচিত্ত নয়!
মৃগাঙ্ক ভাবলেন, সপত্ন-সম্পর্ক সম্বন্ধে পুরুষ বোধ করি মেয়েদের চাইতে অনেক বেশি কুটিল ক্ষুদ্রচেতা ঈর্ষাপরায়ণ।
ভাবলেন, আরও অনেক আগে এভাবে আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত ছিল তার।
.
কে বলেছে এ কথা?
তীক্ষ্ণ প্রশ্ন নয়, যেন হতাশ নিশ্বাস! সেই হতাশ নিশ্বাস থেকেই আবার প্রশ্ন হয়, বলেছে বলেই তাই বিশ্বাস করেছ তুমি? তুমি কি পাগল?
কিন্তু প্রশ্ন করবারই বা কি আছে? সীতু যে পাগল নয় এ প্রমাণ তো দিচ্ছে না। পাগলের মতই তো করছে সীতু। বিছানায় মাথা ঘষটাচ্ছে, আর বলছে না তুমি মিথ্যে কথা বলছ। আমার বাবা মরে গেছে। আমি এখানে থাকব না, আমি চলে যাব, আমি মরে যাব!
আচ্ছা ঠিক আছে, তোমাকে থাকতে হবে না এখানে অতসী তেমনি হতাশ কণ্ঠে বলে, তোমার অন্য ব্যবস্থা করব। শুধু যে কটা দিন তা না হচ্ছে, একটু শান্তিতে থাকতে দাও আমায়।
না না পাগলের মতই গোঁ গোঁ করছে সীতু, আমি এক্ষুনি চলে যাব। আমি এক্ষুনি চলে যাব।
চলে যাবি! আমার জন্যে তোর মন-কেমন করবে না?
না না না। তুমি খুকুর মা, তুমি এদের বাড়ির লোক।
অতসী এবার দপ করে জ্বলে উঠে দৃঢ়কণ্ঠে বলে, রোসো, সত্যিই তোমাকে বোর্ডিঙে রাখবার ব্যবস্থা করছি আমি।