.
খিদেয়, গরমে ঘাড় গুঁজে বসে থাকার কষ্টে, আর কানের জ্বালায় দুঃখের অবধি নেই, তবু আজ মনে ভারি আনন্দ সীতুর।
বাবার খুব একটা অনিষ্ট করতে পারা গিয়েছে ভেবে খুব আনন্দ হচ্ছে তার। বোঝাই যাচ্ছে জিনিসটা খুব দরকারী।
হোক মার খেতে, হোক বকুনি খেতে, তবু সীতু এমনি করে জ্বালাতন করবে বাবাকে। দরকারি জিনিস নষ্ট করে দিয়ে, জুতোর মধ্যে কাঁচের কুচি পুরে, আর প্যান্টের পকেটে ধারালো ব্লেড ভরে রেখে।
ধারালো ব্লেড সীতুর মনের মতই ধারালো। সেটা এখনো বাকি আছে।
প্যান্টের যে পকেটে টাকার ব্যাগ আর গাড়ির চাবি থাকে মৃগাঙ্কর, সেই পকেটের মধ্যে লুকিয়ে রাখবে সীতু সেই সংগ্রহ করে রাখা ব্লেডখানা। পকেটে হাত ভরে জিনিস নিতে গেলেই,–হি হি, চমৎকার! আরও অনেক জ্বালাতনের চিন্তা করতে থাকে সীতু। জ্বালাতন করে করে বাবাকে মরিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার।
হঠাৎ কোথা থেকে কাদের কথা কানে আসে। ফিস ফিস কথা।
কি কথা এসব? কার কথা? কার গলা?
য্যাতোই হোক, কাঁচা ছেলে বই তো নয়, করে ফেলেছে একটা অকম্ম, তা বলে কি আর অমন মারটা মারে? আপনার ছেলে হলে কি আর পারত?
এ গলা বাসনমাজা ঝি সুখদার।
উত্তর শোনা যায় বামুন মেয়ের গলায়, তুই থাম্ সুখী, নিজের বাপে শাসন করে না? মেরে পাট করে দেয় না অমন ছেলেকে? ছেলের গুণ জানিস তুই? আমার বিশ্বাস পুঁটকে ছোঁড়া জানে সব। তা নইলে কর্তার ওপর অত আক্রোশ কিসের?
বিহ্বল হয়ে এদিক ওদিক তাকায় সীতু। কার কথা বলছে ওরা?
কোন ছেলে সে? কে তাকে শাসন করেছে? নিজের বাপ আপনার ছেলে এ সব কি কথা? কী জানে সীতু?
ভয়! ভয়! হঠাৎ সমস্ত শরীরে কাঁপুনি দিয়ে ভয়ানক একটা ভয় করে আসে সীতুর। বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে যায়, আর ওর সেই আবছা আবছা ছবিটা কি রকম যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মনে পড়েছে, ঠিক মনে পড়েছে। জানলায় বসা সেই ছেলেটা আর কেউ নয়, সীতু।
সীতু সে বাড়ির নল দিয়ে জলপড়া চৌবাচ্চাওলা ভাঙা ভাঙা সেই বাড়িটার। সীতু এখানের কেউ নয়, এদের কেউ নয়।
ভয়, ভয়, ভয়ানক ভয়!
কী কাঁপুনি! কী কষ্ট! ভয়ে এত কষ্ট হয়?
.
অফিসে আজ আর কিছুতেই কাজে মন বসে না মৃগাঙ্কর। নিজের সকালের সেই মাত্রাহীন অসহিষ্ণুতার কথা মনে পড়ে লজ্জায় কুণ্ঠায় বিচলিত হতে থাকেন।
ছি ছি, ক্রোধের এমন উন্মত্ত প্রকাশ মৃগাঙ্কর মধ্যে এল কি করে? অতগুলো চোখের সামনে অমন নির্লজ্জ অসভ্যতা করলেন কি করে তিনি? কানটা কি যথাস্থানে আছে ছেলেটার? না ছিঁড়ে পড়ে গেছে?
অতসী কি আজ কথা বলেছে? খেয়েছে? খুকুকে খাইয়েছে?
বাড়ি গিয়ে কি অতসীকে দেখতে পাবে মৃগাঙ্ক? নাকি সে তার ছেলে নিয়ে কোথাও চলে গেছে? দুলাইন চিঠির মারফতে নিষেধ করে গেছে খুঁজতে?
বড় বেশি হয়ে গিয়েছিল!
কিন্তু ছেলেটা যে কিছুতেই কাঁদে না, দোষ স্বীকার করে না, আর করব না বলে না! মানুষের তো রক্তমাংসের শরীর! কত সহ্য করা যায়?
মনে করলেন, যদি ঈশ্বর-অনুগ্রহে যথাযথ সব দেখতে পান, তাহলে নিজেকে আশ্চর্য রকম বদলে ফেলবেন তিনি। অবহেলা করবেন ওই ছোট ছেলেটার সমস্ত দৌরাত্মি। শান্ত হবেন, সহিষ্ণু হবেন, উদার ক্ষমাশীল হবেন। আর কিছুতেই বিচলিত হবেন না।–
ভাবলেন, ছি ছি, ও কি আমার রাগের যোগ্য, ও কি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী? ওর বাচ্চা বুদ্ধির শয়তানী কতটুকু ক্ষতি করতে পারবে ডাক্তার মৃগাঙ্কমোহনের?
অতসীর জন্যে মমতায় মনটা ভরে ওঠে। তার প্রতিও বড় অবিচার করা হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো তার কি দোষ? এতদিনের অসাবধানতা আর ত্রুটির পূরণ করে নেওয়ার মত জোরালো কী নিয়ে গিয়ে দাঁড়ানো যায় অতসীর সামনে? কতটা স্নেহ সমাদর আদর?
ভাবতে ভাবতে আবার চিন্তার ধারা অন্য খাতে বইতে থাকে।
সীতু অত ওরকম করেই বা কেন? এই বিকৃত বুদ্ধির কারণ কি শুধুই বংশগত? নাকি ও মৃগাঙ্কর সঙ্গে নিজের সম্বন্ধটা বোঝে?
কেউ কি ওকে কিছু বলেছে?
কিন্তু কে বলে দেবে? কার এত সাহস?
মৃগাঙ্কর আদেশ অমান্য করতে পারে এতবড় দুর্জয় সাহসধারী কে আছে? অতসীই বলেনি তো? কিন্তু অতসীর তাতে স্বার্থ কি?
তবে কি ওর সব মনে আছে?
তাই কি সম্ভব? কত বয়েস ছিল ওর তখন? বড় জোর দুই। কিন্তু তখন থেকেই কি ছেলেটা অমনি বিরুদ্ধভাবাপন্ন নয়?
সেই প্রথম দিনকার স্মৃতি থেকে তন্ন তন্ন করে মনে করতে থাকেন, কে কাকে প্রথম বিরুদ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছিল। তিনি সীতুকে, না সীতু তাকে?
একেবারে প্রথম কবে দেখেছিলেন ওকে? সুরেশ রায়ের সেই বাড়াবাড়ি অসুখের দিন না? চোখ উল্টে মুখে ফেনা ভেঙে একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছিল বললেই হয়।
অতসী পাংশুমুখে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল বেতপাতার মত, আর রোগা কাঠিসার ছেলেটা অবিরত তার আঁচল ধরে টানছিল আর কাঁদছিল–মা তলে আয়, মা ওখান থেকে তুলে আয়।
দেখেই কেন কে জানে রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গিয়েছিল মৃগাঙ্কর। সহসা ইচ্ছে হয়েছিল ওটাকে টিকটিকি আরশোলার মত ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেন ঘরের বাইরে।
সেই প্রথম দেখা। সেই বিরূপতার সুরু।
.
তারপর অনেক ঝড়ের পর যখন অতসীকে নিয়ে এলেন ঘরে, বিবাহের দাবির মধ্য দিয়ে, তখন তার ছেলের যত্ন আদরের ত্রুটি রাখেন নি ঠিক কথা, কিন্তু সেটা কি আন্তরিক?
আপন অন্তর হাতড়ে আজ সেই ছবছর আগের দিনগুলোকে বিছিয়ে ধরে নিরীক্ষণ করছেন মৃগাঙ্ক। দেখছেন যা কিছু করেছেন সীতুর জন্যে, তার সবটাই অতসীর মন প্রসন্ন রাখার তাগিদে, না কিছুটাও সত্যবস্তু ছিল?