তার আগেই বেঁধেবেড়ে স্বামীকে ভাত বেড়ে দিতে হল অতসীকে, কাঁচতে হল তার ছাড়া ধূতি, জুতোয় কালি লাগাতে হল, হল ভাঁড়ারে কি ফুরিয়েছে তার হিসাব জানাতে।
কিন্তু সুযোগ আর অবকাশ পেলেই কি সেই নিতান্ত বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন নীরস আর বিরস ধরনের মনটা কোমল লাবণ্যে মণ্ডিত হয়ে উঠতে পারত?
কে জানে পারতো কিনা। কিন্তু এটা দেখা গেল স্বার্থপরতায় আর ফিচলেমিতে সে তার বাপের ওপরে যায়। নিজের ছেলের প্রতিই হিংসেয় কুটিল হয়ে উঠছে সে মুহুর্মুহু। ছেলে কাঁদলেই রুক্ষ গলায় ঘোষণা করবে সে দাও দাও গলাটা টিপে শেষ করে দাও, জন্মের শোধ চীৎকার বন্ধ হোক। ছেলে রাতে জেগে উঠে জ্বালাতন করলে বলতো ভালো এক জ্বালা হয়েছে, সারাদিন খাটব খুটব আর রাতে তোমার সোহগের ছেলের সানাই বাঁশি শুনব। বেরিয়ে যাও বেরিয়ে যাও আপদটাকে নিয়ে। দেব, এবার ঢাকীসুন্ধুই বিসর্জন দেব।
ছেলে নিয়ে ছাতে চলে যেত অতসী, শীতের দিনে হয়তো বা ভাঁড়ারের কোণে।
তা সারাদিনের খাটা খোটার গৌরব বেশিদিন ব্যাখ্যান করতে হল না সেই লোকটাকে, এক দুরারোগ্য ব্যাধি এসে বিছানায় পেড়ে ফেলল তাকে। আর তার এই দুর্ভাগ্যের জন্যে দায়ী করল সে শিশুটাকে। অপয়া লক্ষ্মীছাড়া শিশুটাকে।
ছেলের সঙ্গে রেষারেষি।
অতসীর সাধ্য সামর্থ্য সময় সব নিয়োজিত হোক তার নিজের জন্যে। ওই লক্ষ্মীছাড়াটার কিসের দাবী? বাসনমাজা ঝিটার কাছে পড়ে থাক না ওটা। নয়তো বিলিয়েই দিকগে না ওকে অতসী।
এরপর তো ওই ছেলের হাত ধরে ভিক্ষে করে বেড়াতে হবে! তা আগে থেকেই ভারমুক্ত হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
নিজে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে ছেলের মরণকামনা করেছে লোকটা।
মরে না! আপদটা সরেও না! দেখছি কাঠবেড়ালীর প্রাণ!
রোগবিকৃত মুখটা কুটিল হিংসেয় আরও বিকৃত হয়ে উঠত।
দুরারোগ্য রোগ, এ ঘরে ছেলে নিয়ে শোওয়া চলে না, আর সেই নিতান্ত শিশুটাকে সত্যিই রাতে একা ঘরে ফেলে রেখে দেওয়া যায় না। কিন্তু যে মন কোনদিনই যুক্তিসহ নয়, সে মন ভাগ্যের এই মার খেয়ে কি যুক্তিসহ হবে? বরং আরও অবুঝ গোঁয়ার হয়ে ওঠে। ভাবে, ওই ছেলেটার ছুতো করে অতসী তার হাত থেকে পিছলে পালিয়ে যাচ্ছে।
জীবন তোগোনাদিনে পড়েছে, ফুরিয়ে আসছে জীবনের ভোগ, হাহাকার করা বুভুক্ষু চিত্ত নিংড়ে নিতে চায় শেষ ভোগরস। যে মানুষগুলো আস্ত দেহ নিয়ে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের ছিঁড়ে কুটে ফেলতে পারলে যেন তার আক্রোশ মেটে।
সেই হতভাগা লোকটার মনস্তত্ত্ব তবু বুঝতে পারত অতসী, কিন্তু সীতু কেন এমন? কোন কিছু না বুঝেই, ও কেন এমন হিংস্র?
অন্যকে সুখী আর স্বচ্ছন্দ দেখলেই কি ওদের ভিতরের রক্তধারা শয়তানীর বিষবাষ্পে নীল হয়ে ওঠে?
২. সকালবেলা জেগে উঠে
সকালবেলা জেগে উঠে দেখল মৃগাঙ্ক ঘুমোচ্ছে, মুখে নির্মল একটা প্রশান্তি। দিনের বেলায় যেটা প্রায় দুর্লভ হয়ে উঠেছে। বদলে গেল মন, ভারি একটা আনন্দে ছলছল করতে করতে স্নান করতে গিয়েছিল অতসী, অনেক উপকরণে সমৃদ্ধ স্নানের ঘরে।
কিন্তু স্নানের ঘর থেকে বেরিয়েই চমকে কাটা হয়ে গেল মৃগাঙ্কর প্রচণ্ড চীৎকারে।
ঘুম থেকে উঠেই কাকে এমন বকাবকি করছেন রাশভারী মৃগাঙ্ক ডাক্তার? কেনই বা করছেন? আবার কি সেদিনের মত জুতোর মধ্যে কাঁচের কুচি পেয়েছেন?
না, কাঁচের কুচি নয়, কাগজের কুচি।
কাগজের কুচি পেয়েছেন মৃগাঙ্ক! জুতোর মধ্যে নয়, জুতোর তলায়। যে কাগজের গোছাখানা কাল খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছিলেন মৃগাঙ্ক, হয়রান হয়েছিল অতসী। সকালবেলা বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানটুকুতে একপাক ঘুরে গাছ-গাছালিগুলোর তদারক করা মৃগাঙ্কর বরাবরের অভ্যাস। আজও এসেছিলেন নেমে, এসে দেখলেন সারা জমিটায় কাগজের কুচি ছড়ানো।
সেই কালকের জার্নালখানা। কে যেন দুরন্ত রাগে কুটি কুটি করে দাঁতে ছিঁড়ে ছড়িয়েছে! কে? কে? কে করেছে এ কাজ?
রাগে পাগলের মত হয়ে চেঁচামেচি করেছেন মৃগাঙ্ক, বাড়ির সবকটা চাকরবাকরকে ডেকে জড় করেছেন, তারপর হয়েছে রহস্যভেদ।
আসামীকে এনে হাজির করেছে নেবাহাদুর পাঁজাকোলা করে। কারণ অপরাধটা তার নিজের চক্ষে দেখা। •
এখন অপরাধীর কানটা ধরে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিচ্ছেন মৃগাঙ্ক, আর প্রচণ্ড ধমক দিচ্ছেন, কেন করেছ এ কাজ? বল কেন করেছ? না বললে ছাড়ব না আমি।
সকালবেলার ঘুমভাঙা মনে কোন অন্যায় দেখলে রাগটা বুঝি বেশিই হয়ে পড়ে। ঝাঁকুনির চোটে কানটা ছিঁড়ে যাবে মনে হচ্ছে।
অতসী নেমে এসেছে কোনওরকমে একখানা শাড়িজামা জড়িয়ে, খুকুকে কোলে করে তার ঝিটাও।
দাদা মাত্তে বাবা। হাঁ করে কেঁদে ওঠে খুকু।
আর অতসীর আর্তনাদটাও খুকুর মতই শোনায়।
মরে যাবে যে! কি করছ?
অমন ছেলের মরাই উচিত। বলে পরিস্থিতিটার দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে চলে যান মৃগাঙ্ক।
আস্তে আস্তে সকলেই চলে যায় আপন কাজে, সময়মত খায়-দায়। শুধু বাগানের এককোণে ঘাড় গুঁজে অভুক্ত বসে থাকে একটা দুর্মতি শিশু, আর নিজের ঘরের এককোণে তেমনি বসে থাকে অতসী। আজ বুঝি খুকুর কথাও মনে নেই তার।
মৃগাঙ্ককে দোষ দেবার তো মুখ নেই অতসীর, তবু তার প্রতিই অভিমানে ক্ষোভে মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। বারবার মনে হয়, সে একটা অবোধ শিশু বই তো নয়, তার প্রতি এত নিষ্ঠুরতা সম্ভব হল এ শুধু অতসীর একার সন্তান বলেই তো?