হাতে তার তখনও হলুদ মাখানো সুতো বাঁধা, রূপোর জাতিখানা সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে তখনও। যেমন ফিরছিল অতসীর হাতে কাজললতা!
স্বামীর মনের ভাব সেদিন বুঝতে পারে নি অতসী। বুঝতে পারে নি সেও তার বাপকে অবিশ্বাস করেছে কিনা।
কিন্তু শুধু সেদিন কেন?
কোনদিনই কি? কোনদিনই কি বুঝতে পেরেছে তাকে অতসী? শুধু তাকে দেখেছে ভেবেছে মানুষ কেন অকারণে রুক্ষ হয়, কেন নিষ্ঠুরতায় আমোদ পায়?
সবাই ওঘরে। শুধু একা অতসী ব্যর্থ ফুলশয্যার ঘরে খালি মাটিতে পড়ে থেকে কাটিয়ে দিয়েছিল।
একবার কি কাজে যেন সে ঘরে এসেছিল বিয়ের বরটা। এসেছিল কি একটা ওষুধ নিতে ব্যস্তভঙ্গীতে। স্তু থমকে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, এভাবে মাটিতে কেন? বিছানায় উঠে শুলে ভাল হত।
বিছানা মানে সেই বিছানা। যার উপর শিশিখানেক এসেন্স ঢেলে দিয়েছিল কে বা কারা, আর ফুল ছিল অনেক।
তারা হয়তো পাড়ার লোক, নিষ্পর।
ভয়ানক একটা বিস্ময় এসেছিল সেদিন অতসীর।
ভেবেছিল ও কি সত্যিই মনে করেছিল অতসী মাটি থেকে উঠে একা ওই সুরভিসিক্ত রাজকীয় শয্যায় গিয়ে শোবে? এত নীরেট ও, এত ভাবলেশশূন্য?
আর তা যদি না হয়, শুধু মৌখিক একটু ভদ্রতা মাত্র করতে এল ফুলশয্যার রাতে নব পরিণীতার সঙ্গে? হৃদয়াবেগশূন্য এই সম্ভাষণে?
তবু তখনি মনকে সামলে নিল অতসী। ছি ছি, এ কী ভাবছে সে? বাপের বাড়াবাড়ি অসুখ, এখন কি ও আসবে প্রিয়া সম্ভাষণে? তাহলেই তো বরং ঘৃণা আসত অতসীর।
অতএব ধড়মড় করে উঠে বসে খুব আস্তে বলল, আমি ওঘরে যাব?
তুমি? না, তুমি আর গিয়ে কি করবে? তোমার যাবার কি দরকার? তুমি ঘুমোতে পারো। বলে নিজের প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহ করে চলে গেল সে।
কী নীরস সংক্ষিপ্ত নির্দেশ! একটু মিষ্টি করে বলা যেত না?
তাড়াতাড়ি ভাবল অতসী, ছি ছি, ওর বাবার অসুখ! যায় যায় অবস্থা!
আবার ভাবল, আচ্ছা, হঠাৎ যদি তার কিছু হয়ে যায়! শিউরে উঠল ভাবতে গিয়ে।
তাহলে কী বলবে লোকে অতসীকে? কত অপয়া!
কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবতে হল না, ঝি এসে ডাকল, নতুন বৌদিদি, পিসিমা বলছে ওঘরে গিয়ে বসতে। যাও শশুরের পায়ে হাত বুলোও গে যাও। এখন কি হয় কে জানে! ছেলে-অন্ত-প্রাণ তো! যত আবদার ছেলের ওপর। সেই ছেলে হাতছাড়া হয়ে গেল, শোকটা সামলাতে পারছে না মানুষটা।
হাতছাড়া!
অতসীর মনে হল, জীবনে এত দিন যে ভাষায় কথা কয়ে এসেছে সে, শুনেছে যে ভাষায় কথা, শুধু সেইটুকু মাত্রই বাংলা ভাষার পরিধি নয়। এ ভাষা তার কাছে ভয়ঙ্কর রকমের নতুন।
তবু উঠে গেল সেবায় তৎপর হতে। আর গিয়েই প্রথম ধরা পড়ল সেই সন্দেহটা।
না, কিছু হয়নি ভদ্রলোকের। অকারণ কাতরতা দেখিয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন বড় ছেলের হাত দুখানা। স্বাভাবিক মুখ, স্বাভাবিক নিঃশ্বাস। যেটা অস্বাভাবিক সেটা চেষ্টাকৃত।
কিন্তু শুধুই কি সেই একদিন? দিনের পর দিন নয়?
মিথ্যা সন্দেহ নয়। সত্যিই রোগের ভান করে রাতের পর রাত ছেলেকে আঁকড়ে বসে রইলেন বৃদ্ধ। ছেলে চোখের আড়াল হলেই নাকি মারা যাবেন তিনি।
যতবারই পিসশাশুড়ি বলেছেন, করাত জাগছে ছেলেটা, এইবার একটু শুতে যাক দাদা? ততবারই বৃদ্ধ ঠিক তন্মুহূর্তেই চেহারায় নাভিশ্বাসের প্রাক্-চেহারা ফুটিয়ে তুলে মুখে ফেনা তুলে মাথা চেলে গোঁ গোঁ করে একাকার করেছেন। গেল গেল রব উঠে গেছে, মুখে গঙ্গাজল, কানে তারকব্রহ্ম নাম! কতক্ষণে একটু সামলানো।
বিয়ের অষ্টাহ এই ভাবেই কেটেছিল।
তা অষ্টাহই বা কেন, যতদিন বেঁচেছিলেন সেই অভিনেতা বৃদ্ধ, ততদিনই প্রায় একই অবস্থায় কেটেছে অতসীর। অনবরত হার্টফেলের ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে দীর্ঘ চারটি বছর কাটিয়ে অবশেষে সত্যই একদিন হার্টফেল করলেন তিনি। কিন্তু ততদিনে জীবনের রঙ বিবর্ণ হয়ে এসেছে অতসীর, দিনরাত্রির আবর্তন যেন একটা যন্ত্রের মত হয়ে উঠেছে।
তারপর সীতু কোলে এল। নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক জীবনের মাঝখানে নিরুত্তাপ অভ্যর্থনা-হীন সেই অবির্ভাব। দোষও দেওয়া যায় না কাউকে। অভ্যর্থনার পরিবেশও নেই তখন। আচমকা ওপরওলার সঙ্গে খিটিমিটি করে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে তখন সেই কাঠগোবিন্দ ধরনের মানুষটা। ছেলের জন্মসংবাদে শুধু মুখটা একটু কুঁচকে বলল, মেয়ে হয়ে এলে নুন খেয়ে খুন হতে হত, সেই ভয়েই বোধকরি ছেলের মূর্তিতে এসেছে।
পিসি সেই সেবার বিয়েতে এসেছিলেন, আবার এসেছেন এই উপলক্ষে। তিনি বললেন, দেখো–ছেলের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখো যেন সদ্য দাদার মুখ! দাদাই আবার ফিরে এসেছেন রে, বড় আকর্ষণ ছিল তো তোর ওপর!
ঘরের মধ্যে থেকে ভয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল অতসীর। এ কী ভয়ঙ্কর কথা! এ কী সর্বনেশে কথা! যে মানুষটা তার জীবনের রাহু ছিল আবার সে ফিরে এল।
অতসীর ধারণা হয়েছিল প্রথম মিলনের পরম শুভলগ্নটা ব্যর্থ হতেই জীবনটা এমন অভিশপ্ত হয়ে গেছে তার। মন্ত্রের ধ্বনি বাতাসে মিশিয়ে গেছে শক্তিহারা হয়ে, প্রেমের দেবতা প্রতীক্ষা করে হতাশ হয়েই বোধ করি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে যে শর ছুঁড়ে চলে গিয়েছেন, সে শর পঞ্চশরের একটা নয়। আলাদা কিছু!
আলাদা কোন বিষবাণ!
আর এ সমস্তর কারণ একজন নিষ্ঠুর লোকের স্বার্থপরতা!
জীবনের দল ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হবার সুযোগ পেল না, অবকাশ হল না পরস্পরের মধ্যে কোমল লাবণ্যমণ্ডিত একখানি পরিচয় গড়ে ওঠবার।