.
টেবিলের ওপর একখানা জার্নাল ছিল, কোথায় গেল অতসী?
রাত্রে অনেক রাত অবধি পড়াশোনা করেন ডাক্তার, করেন শোবার ঘরেই, টেবিল ল্যাম্পের আলোয়। আগে নীচতলায় লাইব্রেরী ঘরে পড়তেন, খুকুটা হওয়ার পর থেকে উঠে আসেন উপরে। খুকুর জন্যে নয়, খুকুর মার জন্যেই।
মেয়ে জন্মাবার পর অনেকদিন ধরে নানা জটিল অসুখের মধ্যে কাটাতে হয়েছে অতসীকে। তখন মৃগাঙ্ক অনেকটা সময় কাছে না থাকলে চলত না।
সেই থেকে রয়ে গেছে অভ্যাসটা। শুতে এসে তাই এই প্রশ্ন।
অতসী বিমূঢ়ের মত এদিক ওদিক তাকায়, ঘরের টেবিল থেকে কোন কিছুই তো নড়ানো হয় নি।
কি হল সেটা? তাতে যে ভীষণ দরকারী একটা আর্টিকেল রয়েছে, আজ রাত্রেই পড়ে রাখব ঠিক করেছি। খোঁজ খোঁজ!
কিন্তু কোথায় খুঁজবে অতসী? অতসীর ঘরটা তো খুঁটে কয়লার ঘর নয়। চাল ডাল মশলার ভাড়ার নয় যে, কিসের তলায় ঢুকে গেছে, হারিয়ে গেছে। ছিমছাম ফিটফাট ঘর, সুতোটি এদিক ওদিক হয় না।
খুঁজে পাওয়া গেল না। কোথাও না।
স্বামীর বিশেষ বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়ার পরও খুঁজতে থাকে অতসী। কিছু পড়াশোনা না করে মৃগাঙ্কর এরকম শুয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক।
অবশেষে মৃগাঙ্করই মমতা হল। কাছে ডাকলেন অতসীকে। কোমল স্বরে বললেন, আর বৃথা কষ্ট কোর না, এসো শুয়ে পড়ো। এখুনি তো আবার খুকু জেগে উঠে জ্বালাতন করবে!
মা বাপে বিয়ে দেওয়া, অবলীলায় পাওয়া স্বামী নয়, মৃগাঙ্ক অতসীর ভালবেসে পাওয়া স্বামী। বয়সে অনেকটা তফাৎ সত্ত্বেও প্রাণ ঢেলে ভালবেসেছিল অতসী মৃগাঙ্ককে, শ্রদ্ধা করেছিল ত্রাণকর্তার মত, ভক্তি করেছিল দেবতার মত।
আর মৃগাঙ্ক?
মৃগাঙ্কও তো কম ভালবাসেন নি, কম করুণা করেন নি, কম স্নেহ সমাদর করেন নি।
তবু কেন ভয় ঘোচ না অতসীর? তবু কেন মৃগাঙ্ক একটু কাছে টেনে কোমল স্বরে কথা বললেই চোখে জল আসে তার?
মা বাপে বিয়ে দেওয়া, অবলীলায় পাওয়া স্বামীর জন্যে বুঝি মনের মধ্যে এমন দায় থাকে না, থাকে না এমন হারাই হারাই ভাব। সেখানে অনেক পেলেও পাওয়ার মধ্যে কৃতজ্ঞতা বোধ রাখতে হয় না, মনকে দিয়ে বলাতে হয় না, তুমি কত দিচ্ছ! তুমি কত মহৎ।
প্রাপ্য পাওনায় আবার কৃতজ্ঞতা বোধ কিসের? অনায়াসলব্ধকে জমার খাতায় টিকিয়ে রাখবার জন্যে আবার আয়াস কিসের? যেখানে আমিই দাতা, আমি দান করছি আমাকে, সমর্পণ করছি আমাকে, উপহার দিচ্ছি আমার আমিটাকে–সেখানে অনন্ত দায়!
যে আমিকে উপহার দিচ্ছি, সমর্পণ করছি, দান করছি, সে আমিকে তো উপহারের যোগ্য সুন্দর করে তুলতে হবে? সমর্পণের যোগ্য নিখুঁত করে সম্পূর্ণতা দিতে হবে? দানের উপযুক্ত মূল্যবান করে গড়তে হবে?
তাই বুঝি সদাই ভয়! তাই বুঝি সব সময় কৃতজ্ঞতা।
কি হল? কাঁদছ নাকি? কি আশ্চর্য!
অতসী তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলে, তোমার কত অসুবিধে হল! আমার অসাবধানেই তো
আমার অসাবধানেও হতে পারে। আমিই হয়তো আর কোথাও রেখেছি। মিছে নিজেকে দোষী ভাবছ কেন? এটা তোমার একটা মানসিক রোগের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে দেখছি।
অতসী কি উত্তর দেবে?
ঘুমিয়ে পড়, মন খারাপ কোর না। তোমার মুখে হাসি দেখবার জন্যেই আমি কিন্তু রাহমুক্ত পূর্ণশশী কদিনই বা দেখতে পেলাম।
নিঃশ্বাস ফেলেন ডাক্তার।
অতসীও নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে, সত্যি কদিনই বা? প্রথমটায় তো অদ্ভুত একটা ভয়, অপরিসীম একটা লজ্জা, আর অনেকখানি আড়ষ্টতা।
মৃগাঙ্কর আত্মীয় সমাজ আছে, নিজের পরিত্যক্ত জীবনেতিহাসের গ্লানিকর স্মৃতি আছে, চির অসন্তুষ্টচিত্ত বেয়াড়া আবদেরে সীতু আছে। এ আড়ষ্টতা ঘুচতে সময় লেগেছে। তারপর এল খুকুর সম্ভাবনা। এল আনন্দের জোয়ার, নতুন করে নব মাতৃত্বের সূচনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল অতসী, উঠল উচ্ছল হয়ে। কৃতজ্ঞতা বোধের দৈন্যটাও বুঝি গিয়েছিল, মূল্যবোধ এসেছিল নিজের উপর।
তাই বুঝি নারী মাতৃত্বে মনোহর! সেই গৌরবে রমণী আর শুধু রমণী নয়, রমণীয়। তার প্রতি অণুপরমাণুতে ফুটে ওঠে সেই গৌরবের দীপ্তি। সে দীপ্তি বলে, শুধু তুমিই আমায় অন্ন আর আশ্রয় দাও নি, আমিও তোমায় দিলাম সন্তান আর সার্থকতা।
.
হয়তো সেই গৌরবের আনন্দে ক্রমশ সহজ হয়ে উঠতে পারত অতসী। কিন্তু সীতু বুঝি পণ করেছে অতসীকে সহজ হতে দেবে না, সুখী হতে দেবে না। ওদের বংশধারাতেই বুঝি আছে এই হিংসুটেমি।
হ্যাঁ আছেই তো। তিন পুরুষ ধরে এই হিংসুটেপনা করে ওরা জ্বালাচ্ছে অতসীকে।
সেবার তো অতসীর নিজের ভূমিকা ছিল না কোথাও কোনখানে। সে তো অনায়াসলব্ধ। মা বাপের ঘটিয়ে দেওয়া বিয়ে। ছাঁদনাতলায় প্রথম শুভদৃষ্টি।
শুভদৃষ্টি!
তা তখন তো তাই ভেবেছিল অতসী। সেই দৃষ্টির সময় সমস্তখানি মন একটি শুভলগ্নের আশায় কম্পিত আবেগে থরথর করে উঠেছিল।
কিন্তু সে শুভলগ্ন তেমন করে প্রত্যাশার মুহূর্তে এসে দেখা দিল না। দিতে দিলেন না শশুর। স্বার্থপর বৃদ্ধ, আপন সন্তানের আনন্দ আহ্লাদ সহ্য করবার ক্ষমতাও নেই তার।
নইলে সত্যিই কি সে রাতে হার্টের যন্ত্রণায় মরমর হয়ে পড়েছিলেন তিনি, যে রাতে অতসীর জন্যে এঘরে ফুলের বিছানা পাতা হয়েছিল?
অতসী বিশ্বাস করেনি। করেনি বাড়ির আর সকলের মুখের চেহারা দেখে। বিয়েবাড়িতে ছিল তো কতজনা। সকলের মুখে যেন অবিশ্বাসের ছাপ।
তবু সকলেই লোক দেখানো আহা উঁহু হায় হায় করেছিল। সকলেই হুমড়ে পড়ে তার ঘরে গিয়ে বসেছিল। তার সঙ্গে বসেছিল নতুন বিয়ের বরও। সমস্ত রাত ঠায় বসেছিল।