সাঁইথিয়া স্টেশনে আসিয়া যখন পৌঁছান গেল তখন বেলা পড়িয়া আসিতেছে। রাজলক্ষ্মীর গোমস্তা কাশীরাম স্বয়ং স্টেশনে আসিতে পারেন নাই—সেদিকের ব্যবস্থা করিতে নিযুক্ত আছেন, কিন্তু জন-দুই লোক পাঠাইয়া পত্র দিয়াছেন। তাঁহার রোকায় অবগত হওয়া গেল যে, ঈশ্বরেচ্ছায় ‘অত্র’ অর্থাৎ তিনি এবং তাঁহার গঙ্গামাটির সমস্ত কুশল। আদেশমত বাহিরে খানচারেক গো-যান অপেক্ষা করিতেছে—তাহার দুইখানি খোলা এবং দুইখানি ছই-দেওয়া। একখানিতে পুরু করিয়া খড়, আর খেজুরপাতার চাটাই বিছান—সেখানি স্বয়ং কর্ত্রীঠাকুরানীর। অপরখানিতে সামান্য কিছু খড় আছে বটে, কিন্তু চাটাই নাই। সেখানে ভৃত্যাদি অনুচরগণের জন্য। খোলা দুইখানিতে মালপত্র বোঝাই হইবে। এবং যদ্যপি স্থানসঙ্কুলান না হয় ত পাইকদিগকে হুকুম করিলে বাজার হইতে আরও একটা যোগাড় করিয়া আনিবে। তিনি আরও জানাইয়াছেন যে, আহারাদি সমাপনপূর্বক সন্ধ্যার প্রাক্কালে যাত্রা করাই বিধেয়। কারণ অন্যথা কর্ত্রীঠাকুরানীর সুনিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিতে পারে। এবং এ বিষয়ে সবিশেষ জ্ঞাত করাইতেছেন যে, পথে ভয়াদি কিছু নাই—স্বচ্ছন্দে নিদ্রা যাইতে পারেন।
কর্ত্রীঠাকুরানী রোকা পাঠ করিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন মাত্র, এবং যে ইহা দিল তাহাকে ভয়াদির কোন প্রশ্ন না করিয়া কেবল প্রশ্ন করিলেন, হাঁ বাবা, কাছাকাছি একটা পুকুর-টুকুর আছে দেখিয়ে দিতে পার, একটা ডুব দিয়ে আসি?
আছে বৈ কি মাঠান্। উই যে হোথাকে—
তা হলে চল ত বাবা দেখিয়ে দেবে; বলিয়া সে তাহাকে এবং রতনকে সঙ্গে লইয়া কোথাকার কোন্ অজানা পুকুরে স্নানাহ্নিক করিতে চলিয়া গেল। অসুখ প্রভৃতির ভয় দেখান নিরর্থক বলিয়া আমি প্রতিবাদও করিলাম না। বিশেষতঃ ইহাতেই যদি বা সে কিছু খায়, বাধা দিলে সেটাও তাহার আজিকার মত বন্ধ হইয়া যাইবে।
কিন্তু আজ সে মিনিট-দশেকের মধ্যেই ফিরিয়া আসিল। গরুর গাড়িতে জিনিসপত্র বোঝাই চলিতেছিল, সামান্য দুই-একটা বিছানা খুলিয়া গাড়িতে পাতা হইতেছে। আমাকে সে কহিল, তুমি কেন এইবেলা কিছু খেয়ে নাও না? সমস্তই ত আনা হয়েচে।
বলিলাম, দাও।
গাছতলায় আসন পাতিয়া একটা কলাপাতে সে সমস্ত গুছাইয়া দিতেছে, আমি নিস্পৃহচিত্তে কেবলমাত্র তাহার প্রতি চাহিয়া আছি, এমন সময় এক মূর্তি আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া হাঁকিল, নারায়ণ!
রাজলক্ষ্মী তাহার ঝুঁটি-করা ভিজে চুলের উপর বাঁ হাতের পিছন দিয়া আঁচলটা আর একটুখানি টানিয়া দিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল। কহিল, আসুন।
অকস্মাৎ এই নিঃসঙ্কোচ নিমন্ত্রণের শব্দে মুখ ফিরাইয়া দেখিলাম এক সাধু দাঁড়াইয়া। অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম। তাহার বয়স বেশি নয়, বোধ হয় কুড়ি-একুশের মধ্যে, কিন্তু যেমন সুকুমার তেমনি সুশ্রী। চেহারাটা কৃশতার দিকেই—হয়ত একটু দীর্ঘকায় বলিয়াই মনে হইল, কিন্তু রঙ তপ্তকাঞ্চনের ন্যায়। চোখ, মুখ, ভ্রূ ও কপালের গঠন নিখুঁত বলিলেই হয়। বাস্তবিক, পুরুষের এত রূপ আর আমি কখনো দেখিয়াছি বলিয়া মনে হইল না।
তাহার পরিধানে গেরুয়া বস্ত্রখানি স্থানে স্থানে ছিন্ন—গ্রন্থিবাঁধা। গায়ের গেরুয়া পাঞ্জাবীরও যেমন জীর্ণ দশা, পায়ের পাঞ্জাবী জুতাজোড়াটিও প্রায় তদ্রূপ; হারাইলে দুঃখ করিবার বিশেষ কিছু নাই। রাজলক্ষ্মী ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া আসন পাতিয়া দিল। মুখ তুলিয়া কহিল, আমি ততক্ষণ খাবার ঠিক করি, আপনাকে মুখ-হাত ধোবার জল দিক?
সাধু কহিলেন, তা দিক, কিন্তু আপনার কাছে আমি অন্য প্রয়োজনে এসেছিলাম।
রাজলক্ষ্মী বলিল, আচ্ছা, আপনি খেতে বসুন, সে পরে হবে এখন। বাড়ি ফেরবার টিকিট চাই ত? সে আমি কিনে দেব। বলিয়া সে মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিল।
সাধুজী গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন, না, সে প্রয়োজন নেই। আমি খবর নিয়েচি আপনারা গঙ্গামাটি যাচ্চেন। আমার সঙ্গে একটা ভারী বাক্স আছে, সেটা যদি কতকটা পথ আপনাদের গাড়িতে তুলে নেন। আমিও ওই দিকেই যাচ্চি।
রাজলক্ষ্মী কহিল, সে আর বেশি কথা কি! কিন্তু আপনি নিজে?
আমি হেঁটেই যেতে পারব। বেশি দূর নয়, ক্রোশ ছয়-সাত হবে।
রাজলক্ষ্মী আর কিছু না বলিয়া রতনকে ডাকিয়া জল দিতে বলিল, এবং নিজে পরিপাটি করিয়া সাধুজীর খাবার সাজাইতে নিযুক্ত হইল। এই কাজটি রাজলক্ষ্মীর নিজস্ব বস্তু, ইহাতে তাহার জোড়া পাওয়া ভার।
সাধু খাইতে বসিলেন, আমিও বসিলাম। রাজলক্ষ্মী খাবারের হাঁড়ি লইয়া পাশেই রহিল। মিনিট-দুই পরে রাজলক্ষ্মী আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, সাধুজী, আপনার নামটি?
সাধু খাইতে খাইতে কহিলেন, বজ্রানন্দ।
রাজলক্ষ্মী কহিল, বাপ্ রে বাপ্! ডাকনামটি?
তাহার কথার ধরনে চাহিয়া দেখিলাম তাহার সমস্ত মুখখানি চাপা হাসির ছটায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু সে হাসিল না, আমিও আহারে মন দিলাম। সাধুজী বলিলেন, সে নামের সঙ্গে আর ত কোন সম্বন্ধ নেই—নিজেরও না, পরেরও না।
রাজলক্ষ্মী সহজেই সায় দিয়া কহিল, তা বটে! কিন্তু মুহূর্তকাল পরেই প্রশ্ন করিল, আচ্ছা সাধুজী, আপনি বাড়ি থেকে পালিয়েছেন কত দিন?
প্রশ্নটি অত্যন্ত অভদ্র। চাহিয়া দেখিলাম, রাজলক্ষ্মীর মুখে হাসি নাই বটে, কিন্তু যে পিয়ারীর মুখখানি আমি প্রায় ভুলিয়া গিয়াছিলাম, এখন রাজলক্ষ্মীর প্রতি চাহিয়া চক্ষের নিমিষে আবার তাহাকেই মনে পড়িয়া গেল। সেই পুরানো দিনের সমস্ত সরসতা তাহার চোখে-মুখে কণ্ঠস্বরে যেন সজীব হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে।