এই কথাটাই মনে আনিয়াও মুখে আনিতে পারিলাম না। কেবল তাহাকে ব্যথা দিব না বলিয়াই নয়, ভাবিলাম কি হইবে বলিয়া? দেব ও দানবে অনুক্ষণ কাঁধ মিলাইয়া মানুষকে যে কোথায় কোন্ ঠিকানায় অবিশ্রাম বহিয়া লইয়া চলিয়াছে, তাহার কি আমি জানি? কি করিয়া যে ভোগী একদিনে ত্যাগী হইয়া বাহির হইয়া যায়, নির্মম নিষ্ঠুর একমুহূর্তে করুণায় গলিয়া নিজেকে নিঃশেষ করিয়া ফেলে, এ রহস্যের কতটুকু সন্ধান পাই! কোন্ নিভৃত কন্দরে যে মানবাত্মার গোপন সাধনা অকস্মাৎ একদিন সিদ্ধিতে ফুটিয়া উঠে তাহার কি সংবাদ রাখি? ক্ষীণ আলোকে রাজলক্ষ্মীর মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া তাহাকে উদ্দেশ করিয়া মনে মনে কহিলাম, এ যদি আমার ব্যথা দিবার শক্তিটাকেই কেবল দেখিতে পাইয়া থাকে এবং ব্যথা গ্রহণ করিবার অক্ষমতাকে স্নেহের প্রশ্রয়ে এতদিন ক্ষমা করিয়াই চলিয়া থাকে ত অভিমান করিবার আমার কি-ই বা আছে!
রাজলক্ষ্মী কহিল, চুপ করে রইলে যে?
বলিলাম, তবু ত এ নিষ্ঠুরের জন্যই সর্বত্যাগ করলে!
রাজলক্ষ্মী কহিল, সর্বত্যাগ আর কই? নিজেকে ত তুমি নিঃস্বত্ব হয়েই আজ আমাকে দিয়ে দিলে, সে ত আর চাইনে বলে ত্যাগ করতে পারলাম না।
বলিলাম, হাঁ, নিঃস্বত্ব হয়েই দিয়েছি। কিন্তু তোমাকে ত তুমি আপনি দেখতে পাবে না—তাই, সে উল্লেখ আমি করবো না।
শ্রীকান্ত – ৩য় পর্ব – ০২
দুই
বাঙ্গলার ম্যালেরিয়া আমাকে যে বেশ শক্ত করিয়াই ধরিয়াছিল তাহা পশ্চিমের শহরে প্রবেশ করিবার পূর্বেই বুঝা গেল। পাটনা স্টেশন হইতে রাজলক্ষ্মীর বাড়িতে আমি অনেকটা অচেতন অবস্থাতেই নীত হইলাম। ইহার পরের মাসটা আমাকে জ্বর, ডাক্তার এবং রাজলক্ষ্মী প্রায় অনুক্ষণ ঘেরিয়া রহিল।
জ্বর যখন ছাড়িল, তখন ডাক্তারবাবু বেশ স্পষ্ট করিয়াই গৃহস্বামিনীকে জানাইয়া দিলেন যে, যদিও এই শহরটা পশ্চিমেরই অন্তর্গত এবং স্বাস্থ্যকর বলিয়াও খ্যাতি আছে, তথাপি তাঁহার পরামর্শ এই যে, রোগীকে অচিরে স্থানান্তরিত করা আবশ্যক।
আবার একবার বাঁধা-ছাঁদা শুরু হইয়া গেল, কিন্তু এবার কিছু ঘটা করিয়া। রতনকে একলা পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, এবার কোথায় যাওয়া হবে রতন?
দেখিলাম, এই নব-অভিযানের সে একেবারেই বিরুদ্ধে। সে খোলা দরজার প্রতি নজর রাখিয়া আভাসে ইঙ্গিতে এবং ফিসফিস করিয়া যাহা কহিল তাহাতে আমি যেন দমিয়া গেলাম। রতন কহিল, বীরভূম জেলার এই ছোট গ্রামখানির নাম গঙ্গামাটি। ইহার পত্তনি যখন কেনা হয় তখন সে একবার মাত্র মোক্তারজী কিষণলালের সহিত সেখানে গিয়াছিল। মা নিজে কখনও যান নাই—একবার গেলে পলাইয়া আসিতে পথ পাইবেন না। গ্রামে ভদ্রপরিবার নাই বললেই হয়,—কেবল ছোট জাতে ভরা,—তাদের না ছোঁয়া যায়, না আসে তারা কোন কাজে।
রাজলক্ষ্মী কেন যে এই-সব ছোটজাতির মধ্যে গিয়া বাস করিতে চাহিতেছে, তাহার হেতু যেন কতকটা বুঝিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, গঙ্গামাটি বীরভূমের কোথায়?
রতন জানাইল, সাঁইথিয়া না কি এমনি একটা ইস্টিসান হইতে প্রায় দশ-বারো ক্রোশ গরুর গাড়িতে যাইতে হয়। পথ যেমন দুর্গম, তেমনি ভয়ানক। চারিদিকে মাঠ আর মাঠ। তাতে না হয় ফসল, না আছে একফোঁটা জল। কাঁকুরে মাটি, কোথাও রাঙ্গা, আবার কোথাও যেন পুড়িয়া কালো হইয়া আছে। এই বলিয়া সে একটুখানি থামিয়া আমাকেই বিশেষ লক্ষ্য করিয়া পুনশ্চ কহিল, বাবু, মানুষে যে সেখানে কি সুখে থাকে আমি ত ভেবে পাইনে। আর যারা এই-সব সোনার জায়গা ছেড়ে সে-দেশে যেতে চায় তাদের আর কি বলবো!
মনে মনে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মৌন হইয়া রহিলাম। এই-সকল সোনার স্থান ত্যাগ করিয়া কেন যে সেই মরুভূমির মধ্যে নির্বান্ধব ছোটলোকের দেশে রাজলক্ষ্মী আমাকে লইয়া চলিয়াছে, তাহা ইহাকে বলাও যায় না, বুঝানও চলে না।
শেষে বলিলাম, বোধ হয় আমার অসুখের জন্যই যেতে হচ্ছে রতন। এখানে থাকলে ভাল হবার আশা কম, এ ভয় সব ডাক্তারেই দেখাচ্ছেন।
রতন বলিল, কিন্তু অসুখ কি কারও হয় না বাবু? সারাবার জন্যে কি তাদের সব ঐ গঙ্গামাটিতেই যেতে হয়?
মনে মনে বলিলাম, জানি না তাহাদের সব কোন্ মাটিতে যাইতে হয়। হয়ত তাহাদের পীড়া সোজা, হয়ত তাহাদের সাধারণ মাটির উপরেই সারে। কিন্তু আমাদের ব্যাধি সহজও নয়; সাধারণও নয়, ইহার জন্য হয়ত ওই গঙ্গামাটিরই একান্ত প্রয়োজন।
রতন কহিতে লাগিল, মায়ের খরচের হিসাবপত্রও আমরা কোনদিন ভেবে পেলাম না। সেখানে না আছে ঘরদোর, না আছে কিছু। একজন গোমস্তা আছে, তার কাছে হাজার-দুই টাকা পাঠানো হয়েছে একটা মেটে বাড়ি তৈরি করবার জন্যে। দেখুন দেখি বাবু, এ কি-সব অনাছিষ্টি কাণ্ডকারখানা! চাকর বলে যেন আর আমরা কেউ মানুষ নয়!
তাহার ক্ষোভ এবং বিরক্তি দেখিয়া বলিলাম, নাই গেলে রতন অমন জায়গায়! জোর করে ত তোমাকে কেউ কোথাও নিয়ে যেতে পারে না!
আমার কথায় রতন কোন সান্ত্বনা লাভ করিল না। কহিল, মা পারেন। কি জানি বাবু কি জাদুমন্ত্র জানেন, যদি বলেন, তোমাদের সব যমের বাড়ি যেতে হবে, এতগুলো লোকের মধ্যে আমাদের এমন সাহস কারও নেই যে বলে, না। বলিয়া সে মুখ ভারী করিয়া চলিয়া গেল।
কথাটা রতন নিতান্তই রাগ করিয়া বলিয়া গেল, কিন্তু আমাকে সে যেন অকস্মাৎ একটা নূতন তথ্যের সংবাদ দিয়া গেল। কেবল আমিই নয়, সকলেরই ঐ এক দশা! ওই জাদুমন্ত্রের কথাটাই ভাবিতে লাগলাম। মন্ত্রতন্ত্রে যে সত্যই বিশ্বাস করি তাহা নয়, কিন্তু এক-বাড়ি লোকের মধ্যে কাহারও যখন এতটুকু শক্তি নাই যে যমের বাড়ি যাইবার আদেশটাকে পর্যন্ত অবহেলা করে, তখন সে বস্তুটাই বা কি!