দক্ষিণের জানালা দিয়া বাটীর মধ্যে দৃষ্টি পড়ায় মনে হইল উঠানের উপর কি যেন একটা হইতেছে—রতন আপত্তি করিতেছে এবং রাজলক্ষ্মী তাহা খণ্ডন করিতেছে, সুতরাং কণ্ঠস্বরটা তাহারই কিছু প্রবল। আমি উঠিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইতেই সে কিছু অপ্রতিভ হইয়া গেল; কহিল, ঘুম ভেঙ্গে গেল বুঝি? যাবেই ত। রতন, তুই গলাটা একটু খাটো কর বাবা, নইলে আমি ত আর পারিনে।
এই প্রকার অনুযোগ এবং অভিযোগে কেবল রতনই একা নয়, বাড়িসুদ্ধ সকলেই আমরা অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিলাম। অতএব সেও চুপ করিয়া রহিল, আমিও তেমনি কথা কহিলাম না।
দেখিলাম একটা বড় চাঙ্গারিতে চাল-ডাল-ঘি-তেল প্রভৃতি এবং আর-একটা ছোট পাত্রে এতজ্জাতীয় নানাবিধ ভোজ্যবস্তু সজ্জিত হইয়াছে। মনে হইল, এইগুলির পরিমাণ ও তাহাদিগকে বহন করিবার শক্তিসামর্থ্য-প্রসঙ্গেই রতন প্রতিবাদ করিতেছিল। ঠিক তাই। রাজলক্ষ্মী আমাকে মধ্যস্থ মানিয়া বলিল, শোন এর কথা! এই ক’টা চাল-ডাল বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না! এ যে আমি নিয়ে যেতে পারি রতন। এই বলিয়া সে হেঁট হইয়া স্বচ্ছন্দে বড় ঝুড়িটা তুলিয়া ধরিল।
বাস্তবিক ভার হিসাবে মানুষের পক্ষে, এমন কি রতনের পক্ষেও এগুলি বহিয়া লইয়া যাওয়া কঠিন ছিল না, কিন্তু কঠিন ছিল আর একটা কাজ। ইহাতে তাহার মর্যাদাহানি হইবে। কিন্তু মনিবের কাছে লজ্জায় এই কথাটাই সে স্বীকার করিতে পারিতেছিল না। আমি তাহার মুখের পানে চাহিয়া অত্যন্ত সহজেই এ কথাটা বুঝিতে পারিলাম। হাসিয়া কহিলাম, তোমার যথেষ্ট লোকজন আছে, প্রজারও অভাব নেই—তাদের কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও, রতন না হয় খালি হাতে সঙ্গে যাক।
রতন অধোমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। রাজলক্ষ্মী একবার আমার ও একবার তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া নিজেও হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, হতভাগা আধঘণ্টা ধরে ঝগড়া করলে, তবু বললে না যে, ও-সব ছোট কাজ রতনবাবুর নয়। যা, কাউকে ডেকে আন্গে।
সে চলিয়া গেলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, সকালে উঠেই এ-সব যে?
রাজলক্ষ্মী বলিল, মানুষের খাবার জিনিস সকালে পাঠাতে হয়।
কিন্তু কোথায় পাঠান হচ্চে? এবং তার হেতু?
রাজলক্ষ্মী কহিল, হেতু মানুষ খাবে এবং যাচ্ছে বামুনবাড়িতে।
কহিলাম, বামুনটি কে?
রাজলক্ষ্মী হাসিমুখে ক্ষণকাল চুপ করিয়া রহিল, বোধ হয় ভাবিল নামটা বলিবে কি না। কিন্তু পরক্ষণেই কহিল, দিয়ে বলতে নেই, পুণ্যি কমে যায়। যাও, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় ছেড়ে এস, তোমার চা তৈরি হয়ে গেছে।
আমি আর কোন প্রশ্ন করিয়া বাহিরে চলিয়া গেলাম।
বেলা বোধ হয় তখন দশটা, বাহিরের ঘরে তক্তাপোশের উপর বসিয়া কাজের অভাবে একখানা পুরানো সাপ্তাহিক কাগজের বিজ্ঞাপন পড়িতেছিলাম, একটা অচেনা কণ্ঠস্বরের সম্ভাষণে মুখ তুলিয়া দেখিলাম—আগন্তুক অপরিচিতই বটে। কহিলেন, নমস্কার বাবুমশায়।
আমিও হাত তুলিয়া প্রতি-নমস্কার করিয়া বলিলাম, বসুন।
ব্রাহ্মণের অতিশয় দীন বেশ—পায়ে জুতা নাই, গায়ে জামা নাই, শুধু একখানি মলিন উত্তরীয়। পরিধানের বস্ত্রখানি তেমনি মলিন, উপরন্তু দু-তিন স্থানে গ্রন্থি বাঁধা। পল্লীগ্রামের ভদ্রব্যক্তির আচ্ছাদনের দীনতা বিস্ময়ের বস্তুও নয়। কেবলমাত্র ইহার উপরেই তাঁহার সাংসারিক অবস্থা অনুমান করাও চলে না। তিনি সম্মুখে বাঁশের মোড়াটার উপরে উপবেশন করিয়া কহিলেন, আমি আপনার একজন দরিদ্র প্রজা, ইতিপূর্বেই আমার আসা কর্তব্য ছিল, ভারি ত্রুটি হয়ে গেছে।
আমাকে জমিদার মনে করিয়া কেহ আলাপ করিতে আসিলে আমি মনে মনে যেমন লজ্জিত হইতাম, তেমনি বিরক্ত হইতাম; বিশেষতঃ ইহারা যে-সকল নিবেদন ও আবেদন লইয়া উপস্থিত হইত এবং যে-সকল বদ্ধমূল উৎপাত ও অত্যাচারের প্রতিবিধান প্রার্থনা করিত তাহাতে আমার কোন হাতই ছিল না। ইঁহার প্রতিও প্রসন্ন হইতে পারিলাম না; কহিলাম, বিলম্বে আসার জন্যে আপনি দুঃখিত হবেন না, কারণ একেবারে না এলেও আমি ত্রুটি নিতাম না—ও-রকম আমার স্বভাব নয়। কিন্তু আপনার প্রয়োজন?
ব্রাহ্মণ লজ্জিত হইয়া কহিলেন, অসময়ে এসে আপনার কাজে হয়ত ব্যাঘাত করলাম, আমি আর একদিন আসব। এই বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
আমি বিরক্ত হইয়া কহিলাম, আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন বলুন?
আমার বিরক্তিটা তিনি আনায়াসে লক্ষ্য করিলেন। একটু মৌন থাকিয়া শান্তভাবে বলিলেন, আমি সামান্য ব্যক্তি, প্রয়োজনও যৎসামান্য। মাঠাকরুন আমাকে স্মরণ করেচেন, হয়ত তাঁর আবশ্যক থাকতে পারে—আমার কিছু নেই।
জবাবটা কঠোর কিন্তু সত্য, এবং আমার প্রশ্নের তুলনায় অসঙ্গতও নয়। কিন্তু এখানে আসিয়া পর্যন্ত নাকি এরূপ জবাব শুনাইবার লোক ছিল না, তাই ব্রাহ্মণের প্রত্যুওরে কেবল বিস্ময়াপন্ন নয়, সহসা ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলাম। অথচ মেজাজ আমার স্বভাবতঃ রুক্ষও নয়, অন্যত্র কোথাও এ কথায় কিছু মনেও হইত না; কিন্তু ঐশ্বর্যের ক্ষমতা জিনিসটা এতই বিশ্রী যে, সেটা পরের ধার করা হইলেও তাহার অপব্যবহারের প্রলোভন মানুষে সহজে কাটাইয়া উঠিতে পারে না। অতএব অপেক্ষাকৃত ঢের বেশি রূঢ় উত্তরই হঠাৎ মুখে আসিয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু ঝাঁজটা তার উৎক্ষিপ্ত হইবার পূর্বেই দেখিলাম পাশের দরজাটা খুলিয়া গেল এবং রাজলক্ষ্মী তাঁহার পূজার আসন হইতে অসমাপ্ত আহ্নিক ফেলিয়া রাখিয়াই উঠিয়া আসিল। দূর হইতে সসম্ভ্রমে প্রণাম করিয়া কহিল, এরই মধ্যে উঠবেন না, আপনি বসুন। আপনার কাছে আমার অনেক কথা আছে।