শিবু কহিলেন, বল, মধু ডোমায় কন্যায় ভুজ্যপত্রং নমঃ।
বর আবৃত্তি করিল, মধু ডোমায় কন্যায় ভুজ্যপত্রং নমঃ।
শিবু কহিলেন, মধু, এবার তুমি বল, ভগবতী ডোমায় পুত্রায় সম্প্রদানং নমঃ।
সকন্যা মধু ইহাই আবৃত্তি করিল। সকলেই নীরব, স্থির। ভাবে বোধ হইল শিবুর মত শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি ইতিপূর্বে এ অঞ্চলে পদার্পণ করে নাই।
শিবু বরের হাতে ফুল দিয়া কহিলেন, বিপিন, তুমি বল, যতদিন জীবনং ততদিন ভাত-কাপড় প্রদানং স্বাহা।
বিপিন থামিয়া থামিয়া বহু দুঃখে বহু সময়ে এই মন্ত্র উচ্চারণ করিল।
শিবু কহিলেন, বর-কন্যা দু’জনেই বল, যুগল মিলনং নমঃ।
বর এবং কন্যার হইয়া মধু ইহা আবৃত্তি করিল। ইহার পরে বিরাট হরিধ্বনিসহকারে বর-কন্যাকে বাটীর মধ্যে বহন করিয়া লইয়া যাওয়া হইল। আমার চতুষ্পার্শ্বে একটা গুঞ্জনরোল উঠিল—সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিতে লাগিল যে, হাঁ, একজন শাস্ত্রজানা লোক বটে! মন্তর পড়ালে বটে! রাখাল পণ্ডিত এতকাল আমাদের কেবল ঠকিয়েই খাচ্ছিল।
সমস্তক্ষণ আমি গম্ভীর হইয়াই ছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত এই অসীম গাম্ভীর্য বজায় রাখিয়াই রাজলক্ষ্মীর হাত ধরিয়া বাটী ফিরিয়া আসিলাম। ওখানে কি করিয়া যে সে আপনাকে সংবরণ করিয়া বসিয়াছিল আমি জানি না, কিন্তু ঘরে আসিয়া হাসির প্রবাহে তাহার যেন দম বন্ধ হইবার জো হইল। বিছানায় লুটাইয়া পড়িয়া সে কেবলই বলিতে লাগিল, হাঁ, একজন মহামহোপাধ্যায় বটে! রাখাল এতদিন এদের কেবল ঠকিয়েই খাচ্ছিল।
প্রথমটা আমিও হাসি রাখিতে পারিলাম না; তাহার পরে কহিলাম, মহামহোপাধ্যায় দু’জনেই। অথচ, এমনি করেই ত এতকাল এদের মেয়ের মা এবং মেয়ের ঠাকুরমার বিয়ে হয়েচে। রাখালের যাই হোক, শিবু পণ্ডিতের মন্ত্রগুলোও ঠিক ঋষিরুবাচ বলে মনে হল না, কিন্তু তবু ত এদের কোন মন্ত্রই বিফল হয়নি। এদের বিবাহ-বন্ধন ত আজও তেমনি দৃঢ় তেমনি অটুট আছে!
রাজলক্ষ্মী হাসি চাপিয়া সহসা সোজা হইয়া উঠিয়া বসিল এবং একদৃষ্টে চুপ করিয়া আমার মুখের পানে চাহিয়া কত কি যেন ভাবিতে লাগিল।
শ্রীকান্ত – ৩য় পর্ব – ০৬
ছয়
সকালে উঠিয়া শুনিলাম কুশারীমহাশয় মধ্যাহ্ন-ভোজনের নিমন্ত্রণ করিয়া গিয়াছেন। ঠিক এই আশঙ্কাই করিতেছিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, আমি একা নাকি?
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া কহিল, না, আমিও আছি।
যাবে?
যাব বৈ কি।
তাহার এই নিঃসঙ্কোচ উত্তর শুনিয়া অবাক হইয়া গেলাম। খাওয়া বস্তুটা যে হিন্দু ধর্মের কি, এবং সমাজের কতখানি ইহার উপর নির্ভর করে, রাজলক্ষ্মী তাহা জানে—এবং কত বড় নিষ্ঠার সহিত ইহাকে মানিয়া চলে আমিও তাহা জানি, অথচ এই তাহার জবাব। কুশারীমহাশয় সম্বন্ধে বেশি-কিছু জানি না, তবে বাহির হইতে তাঁহাকে যতটা দেখা গিয়াছে, মনে হইয়াছে তিনি আচারপরায়ণ ব্রাহ্মণ; এবং ইহাও নিশ্চিত যে, রাজলক্ষ্মীর ইতিহাস তিনি অবগত নহেন, কেবল মনিব বলিয়াই আমন্ত্রণ করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু রাজলক্ষ্মী যে আজ সেখানে গিয়া, কি করিয়া কি করিবে আমি ত ভাবিয়া পাইলাম না। অথচ, আমার প্রশ্নটা বুঝিয়াও সে যখন কিছুই কহিল না, তখন ইহারই নিহিত-কুণ্ঠা আমাকেও নির্বাক্ করিয়া রাখিল।
যথাসময়ে গো-যান আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি প্রস্তুত হইয়া বাহিরে আসিয়া দেখিলাম রাজলক্ষ্মী গাড়ির কাছে দাঁড়াইয়া।
কহিলাম, যাবে না?
সে কহিল, যাবার জন্যেই ত দাঁড়িয়ে আছি। এই বলিয়া সে গাড়ির ভিতরে গিয়া বসিল।
রতন সঙ্গে যাইবে, সে আমার পিছনে ছিল। ঠাকুরানীর সাজসজ্জা দেখিয়া সে যে নিরতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইল, তাহার মুখ দেখিয়া তাহা বুঝিলাম। আমিও আশ্চর্য হইয়াছিলাম; কিন্তু সেও যেমন প্রকাশ করিল না, আমিও তেমনি নীরব হইয়া রহিলাম। বাড়িতে সে কোনকালেই বেশি গহনা পরে না, কিছুদিন হইতে তাহাও কমিতেছিল। কিন্তু আজ দেখা গেল, গায়ে তাহার কিছুই প্রায় নাই। যে হারটা সচরাচর তাহার গলায় থাকে সেইটি এবং হাতে একজোড়া বালা। ঠিক মনে নাই, তবুও যেন মনে হইল, কাল রাত্রি পর্যন্ত যে চুড়ি-কয়গাছি দেখিয়াছিলাম সেগুলিও যেন সে আজ ইচ্ছা করিয়াই খুলিয়া ফেলিয়াছে। পরনের কাপড়খানিও নিতান্ত সাধারণ, বোধ হয় সকালে স্নান করিয়া যাহা পরিয়াছিল তাহাই।
গাড়িতে উঠিয়া বসিয়া আস্তে আস্তে বলিলাম, একে একে যে সমস্তই ছাড়লে দেখচি। কেবল আমিই বাকি রয়ে গেলাম।
রাজলক্ষ্মী আমার মুখের পানে চাহিয়া একটু হাসিয়া কহিল, এমন ত হতে পারে, এই একটার মধ্যেই সমস্ত রয়ে গেছে। তাই যেগুলো বাড়তি ছিল সেইগুলো একে একে ঝরে যাচ্ছে। এই বলিয়া সে পিছনে একবার চাহিয়া দেখিল, রতন কাছাকাছি আছে কি না; তার পরে গাড়োয়ানটাও না শুনিতে পায় এমনি অত্যন্ত মৃদুকন্ঠে কহিল, বেশ ত, সে আশীর্বাদই কর না তুমি। তোমার বড় আর ত আমার কিছুই নেই, তোমাকেও যার বদলে আনায়াসে দিতে পারি আমাকে সেই আশীর্বাদই তুমি কর।
চুপ করিয়া রহিলাম। কথাটা এমন একদিকে চলিয়া গেল যাহার জবাব দিবার কোন সাধ্যই আমার ছিল না। সেও আর কিছু না বলিয়া মোটা বালিশটা টানিয়া লইয়া গুটিসুটি হইয়া আমার পায়ের কাছে শুইয়া পড়িল।
আমাদের গঙ্গামাটি হইতে পোড়ামাটিতে যাইবার একটা অত্যন্ত সোজা পথ আছে। সম্মুখের শুষ্ক-জল খাদটার উপরে যে সঙ্কীর্ণ বাঁশের সাঁকো আছে, তাহার উপর দিয়া গেলে মিনিট-দশেকের মধ্যেই যাওয়া যায়, কিন্তু গরুর গাড়িতে অনেকখানি রাস্তা ঘুরিয়া ঘণ্টা-দুই বিলম্বে পৌঁছিতে হয়। এই দীর্ঘ পথটায় দু’জনের মধ্যে আর কোন কথাই হইল না। সে কেবল আমার হাতখানা তাহার গলার কাছে টানিয়া লইয়া ঘুমানোর ছল করিয়া নিঃশব্দে পড়িয়া রহিল।