রাজলক্ষ্মী প্রশ্ন করিল, আচ্ছা, বাড়িতে থেকে কি ধর্মলাভ হয় না? সংসার না ছাড়লে কি ভগবান পাওয়া যায় না?
প্রশ্ন শুনিয়া আমি করজোড়ে বলিলাম, এর কোনটার জন্যেই আমি ব্যাকুল নই লক্ষ্মী, এ-সব ঘোরতর প্রশ্ন আমাকে তুমি কোরো না, আবার আমার জ্বর আসতে পারে।
রাজলক্ষ্মী হাসিল, তারপর করুণকণ্ঠে কহিল, কিন্তু মনে হয় সংসারে আনন্দর ত সমস্তই আছে, তবু সে ধর্মের জন্য এই বয়সেই সব ছেড়ে দিয়ে এসেচে; কিন্তু তুমি ত তা পারনি?
বলিলাম, না, এবং ভবিষ্যতেও পারব মনে হয় না।
রাজলক্ষ্মী কহিল, কেন মনে হয় না?
কহিলাম, তার প্রধান কারণ যাকে ছাড়তে হবে সেই সংসারটা যে আমার কোথায় এবং কি প্রকার তা আমার জানা নেই, এবং যার জন্যে ছাড়তে হবে সেই পরমাত্মার প্রতিও আমার লেশমাত্র লোভ নেই। এতদিন তাঁর অভাবেই কেটে গেছে এবং বাকি ক’টা দিনও অচল হয়ে থাকবে না এই আমার ভরসা। অন্যপক্ষে তোমার ঐ আনন্দভায়াটিও গেরুয়া সত্ত্বেও যে ঈশ্বরপ্রাপ্তির জন্যেই বেরিয়ে এসেচেন আমার তা বিশ্বাস নয়। তার কারণ, আমিও বারকয়েক সাধু-সঙ্গ করেচি, তাঁদের কেউ আজও ওষুধের বাক্স ঘাড়ে করে বেড়ানকে ভগবৎলাভের উপায় নির্দেশ করে দেননি। তা ছাড়া তাঁর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটাও ত চোখে দেখলে!
রাজলক্ষ্মী মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া বলিল, তবে কি সে মিছামিছিই ঘরসংসার ছেড়ে এই কষ্ট করতে বার হয়েচে? সবাই কি তোমার মতই মনে কর?
বলিলাম, না, মস্ত প্রভেদ আছে। সে ভগবানের সন্ধানে বার না হলেও মনে হয়, যার জন্যে পথে বেরিয়েচে সে তারই কাছাকাছি, অর্থাৎ আপনার দেশ। তাই তার ঘরবাড়ি ছেড়ে আসাটা ঠিক সংসার ছেড়ে আসা নয়—সাধুজী কেবলমাত্র ক্ষুদ্র একটি সংসার ছেড়ে বড় সংসারের মধ্যে প্রবেশ করেচেন।
রাজলক্ষ্মী আমার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল, বোধ হয় ঠিক বুঝিতে পারিল না, তার পরে জিজ্ঞাসা করিল, যাবার সময় সে কি তোমাকে কিছু বলে গেল?
আমি ঘাড় নাড়িয়া কহিলাম, না, তেমন কিছু নয়।
কেন যে একটুখানি সত্য গোপন করিলাম তাহা নিজেও জানি না। কিন্তু বিদায়কালে সাধুজীর শেষ কথাটা তখন পর্যন্ত আমার কানে তেমনি বাজিতেছিল। যাবার সময় সেই যে একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া গেলেন, বিচিত্র দেশ এই বাঙ্গলা দেশটা! এর পথেঘাটে মা-বোন—সাধ্য কি তাদের ফাঁকি দিয়ে যাই!
ম্লানমুখে রাজলক্ষ্মী নিঃশব্দে বসিয়া রহিল, আমারও মনের মধ্যে অনেক দিনের অনেক ভুলে-যাওয়া ঘটনা ধীরে ধীরে উঁকি মারিয়া যাইতে লাগিল। মনে মনে বলিতে লাগিলাম, তাই বটে! তাই বটে! সাধুজী, তুমি যেই হও, এই অল্প বয়সেই আমার এই কাঙাল দেশটিকে তুমি ভাল করিয়াই দেখিয়াছ। না হইলে ইহার যথার্থ রূপটির খবর আজ এমন সহজেই এই কয়টি কথায় দিতে পারিতে না। জানি, অনেক দিনের অনেক ত্রুটি অনেক বিচ্যুতি আমার মাতৃভূমির সর্বাঙ্গ ব্যাপিয়া পঙ্ক লেপিয়াছে, তবুও, এ সত্য যাচাই করিবার যাহার সুযোগ মিলিয়াছে, সে-ই জানে ইহা কত বড় সত্য!
এইভাবে নীরবে মিনিট দশ-পনের কাটিয়া গেলে রাজলক্ষ্মী মুখ তুলিয়া কহিল, এই উদ্দেশ্যই যদি তার মনে থাকে, একদিন আবার তাকে ঘরে ফিরতেই হবে আমি বলে দিচ্চি। এদেশে নিছক পরের ভাল করতে যাওয়ার যে দুর্গতি হয়তো সে আজও জানে না। এর স্বাদ কতক আমি জানি। আমারই মত একদিন যখন সংশয়ে, বাধায়, কটু কথায় তার সমস্ত মন তিক্তরসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে, তখন সে পালিয়ে আসার পথ পাবে না।
আমি সায় দিয়া কহিলাম, অসম্ভব নয়, কিন্তু আমার মনে হয় এ-সব দুঃখের কথা যেন সে বেশ জানে।
রাজলক্ষ্মী বারংবার মাথা নাড়িয়া বলিতে লাগিল, কখ্খনো না, কখ্খনো না। জানলে সে পথে কেউ যাবে না আমি বলচি।
এ কথার আর জবাব ছিল না। বঙ্কুর মুখে শুনিয়াছিলাম, একদিন ইহার অনেক সাধুসঙ্কল্প, অনেক পুণ্যকর্ম তাহার শ্বশুরবাড়ির দেশে অত্যন্ত অপমানিত হইয়াছিল। সেই নিষ্কাম পরোপকারের ব্যথা অনেকদিন ইহার মনে লাগিয়াছিল। যদিচ, আরও একটা দিক দেখিবার ছিল, কিন্তু সেই অবলুপ্ত বেদনার স্থানটা চিহ্নিত করিয়া তুলিতেও আর প্রবৃত্তি হইল না, তাই চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। অথচ রাজলক্ষ্মী যাহা বলিতেছিল তাহা মিথ্যা নয়। মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, কেন এমন হয়? কেন একের শুভচেষ্টা অপরে এমন সন্দেহের চক্ষে দেখে? কেন এগুলি বিফল করিয়া দিয়া মানুষ সংসারের দুঃখের ভার লঘু করিতে দেয় না? মনে হইল, সাধুজী যদি থাকিতেন, কিংবা যদি কখনো ফিরিয়া আসেন, এই জটিল সমস্যার মীমাংসার ভার তাঁকেই দিব।
সেদিন সকাল হইতে নিকটেই কোথা হইতে মাঝে মাঝে সানাইয়ের শব্দ পাওয়া যাইতেছিল, এই সময়ে জনকয়েক লোক রতনকে অগ্রবর্তী করিয়া প্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে আসিয়া দাঁড়াইল। রতন সম্মুখে আসিয়া কহিল, মা, এরা আপনাকে রাজবরণ দিতে এসেছে,—এসো না হে, দিয়ে যাও না। বলিয়া সে একজন প্রৌঢ়গোছের লোককে ইঙ্গিত করিল। লোকটির পরিধানে হরিদ্রারঙে ছোপান একটি কাপড়, গলায় নূতন কাঠের মালা। অত্যন্ত সঙ্কোচের সহিত অগ্রসর হইয়া আসিয়া বারান্দার নীচে হইতেই নূতন শালপাতায় একটি টাকা ও একটি সুপারি রাজলক্ষ্মীর পদতলের উদ্দেশে রাখিয়া মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিল এবং কহিল, মাঠাকরুন, আজ আমার মেয়ের বিয়ে।
রাজলক্ষ্মী উঠিয়া আসিয়া তাহা গ্রহণ করিল এবং পুলকিতচিত্তে কহিল, মেয়ের বিয়েতে এই বুঝি দিতে হয়!