আমি বলিলাম, তা হলে ঠাণ্ডায় আর কষ্ট নাই করলে ভায়া, এসো না আমার গাড়িতে।
সাধু একটু ভাবিয়া কহিলেন, থাক এখন। দিদির সঙ্গে একটু কথা কইতে কইতে যাই।
আমিও ভাবিলাম, তা বটে! নূতন সম্বন্ধটা অস্বীকারের দিকেই সাধুজীর মনে মনে লড়াই চলিতেছিল আমি তাহা লক্ষ্য করিয়াছিলাম, তবুও শেষরক্ষা হইল না। হঠাৎ একসময়ে যখন তিনি অঙ্গীকার করিয়াই লইলেন, তখন অনেকবার মনে হইল একটু সাবধান করিয়া দিয়া বলি, ঠাকুর পালালেই কিন্তু ভাল করতে—শেষে আমার দশা না হয়! অথচ চুপ করিয়া রহিলাম।
দু’জনের কথাবার্তা অবাধে চলিতে লাগিল। গরুর গাড়ির ঝাঁকানিতে এবং তন্দ্রার ঝোঁকে মাঝে মাঝে তাঁহাদের আলাপের সূত্র হারাইতে থাকিলেও কল্পনার সাহায্যে পূরণ করিয়া চলিতে চলিতে আমারও সময়টা মন্দ কাটিল না।
বোধ করি একটু তন্দ্রামগ্নই হইয়াছিলাম, সহসা শুনিলাম—প্রশ্ন হইল, হাঁ আনন্দ, তোমার ঐ বাক্সটিতে কি আছে ভাই?
উত্তর আসিল, গোটা-কয়েক বই আর ওষুধপত্র আছে দিদি।
ওষুধ কেন? তুমি কি ডাক্তার?
আমি সন্ন্যাসী। আচ্ছা, আপনি কি শোনেন নি দিদি, আপনাদের ওদিকে কি রকম কলেরা হচ্ছে?
কৈ না! সে কথা ত আমাদের গোমস্তা আমাকে জানান নি। আচ্ছা ঠাকুরপো, তুমি কলেরা সারাতে পার?
সাধুজী একটু মৌন থাকিয়া বলিলেন, সারাবার মালিক ত আমরা নই দিদি, আমরা শুধু ওষুধ দিয়ে চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু এও দরকার, এও তাঁরই হুকুম।
রাজলক্ষ্মী বলিল, সন্ন্যাসীতেও ওষুধ দেয় বটে, কিন্তু ওষুধ দেবার জন্যেই ত সন্ন্যাসী হতে হয় না। আচ্ছা আনন্দ, তুমি কি কেবল এইজন্যই সন্ন্যাসী হয়েছ ভাই?
সাধু কহিলেন, সে ঠিক জানিনে দিদি। তবে দেশের সেবা করাও আমাদের একটা ব্রত বটে।
আমাদের? তবে বুঝি তোমাদের একটা দল আছে ঠাকুরপো?
সাধু জবাব না দিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
রাজলক্ষ্মী পুনশ্চ কহিল, কিন্তু সেবা করার জন্য ত সন্ন্যাসী হবার দরকার হয় না ভাই। তোমাকে এ মতি-বুদ্ধি কে দিলে বল ত?
সাধু এ প্রশ্নেরও বোধ হয় উত্তর দিলেন না, কারণ কিছুক্ষণ পর্যন্ত কোন কথাই কাহারও শুনিতে পাইলাম না। মিনিট-দশেক পরে কানে গেল সাধু কহিতেছেন, দিদি, আমি ছোট্ট সন্ন্যাসী, আমাকে ও-নাম না দিলেও চলে। কেবল নিজের কতকগুলো ভার ফেলে দিয়ে তার জায়গায় অপরের বোঝা তুলে নিয়েছি।
রাজলক্ষ্মী কথা কহিল না। সাধু বলিতে লাগিলেন, আমি প্রথম থেকেই দেখতে পেয়েচি, আপনি আমাকে ক্রমাগত ঘরে ফেরাবার চেষ্টা করচেন। কেন জানিনে, বোধ হয় দিদি বলেই। কিন্তু যাদের ভার নিতে আমরা ঘর ছেড়ে বেরিয়েচি, এরা যে কত দুর্বল, কত রুগ্ন, কিরূপ নিরুপায় এবং সংখ্যায় কত, এ যদি একবার জানেন ত ও-কথা আর মনেও আনতে পারবেন না।
ইহারও রাজলক্ষ্মী কোন উত্তর দিল না। কিন্তু আমি বুঝিলাম, যে প্রসঙ্গ উঠিল এইবার উভয়ের মন এবং মতের মিল হইতে বিলম্ব হইবে না। সাধুজীও ঠিক জায়গাতেই আঘাত করিলেন। দেশের আভ্যন্তরিক অবস্থা, ইহার সুখ, ইহার দুঃখ, ইহার অভাব আমি নিজেও নিতান্ত কম জানি না; কিন্তু এই সন্ন্যাসীটি যেই হোন, তিনি এই বয়সেই আমার চেয়ে ঢের বেশি ঘনিষ্ঠভাবে দেখিয়াছেন এবং ঢের বড় হৃদয় দিয়া তাহাদিগকে নিজের করিয়া লইয়াছেন। শুনিতে শুনিতে চোখের ঘুম জলে পরিবর্তিত হইয়া উঠিল এবং বুকের ভিতরটা ক্রোধে ক্ষোভে দুঃখে ব্যথায় যেন মথিত হইয়া যাইতে লাগিল। ও-গাড়ির অন্ধকার কোণে একাকী বসিয়া রাজলক্ষ্মী একটা প্রশ্নও করিল না, একটা কথাতেও কথা যোগ করিল না। তাহার নীরবতায় সাধুজী কি ভাবিলেন তাহা তিনিই জানেন, কিন্তু এই একান্ত স্তব্ধতার পরিপূর্ণ অর্থ আমার কাছে গোপন রহিল না।
দেশ বলিতে যেথায় দেশের চৌদ্দ-আনা নরনারী বাস করেন, সেই পল্লীগ্রামের কাহিনীই সাধু বিবৃত করিতে লাগিলেন। দেশে জল নাই, প্রাণ নাই, স্বাস্থ্য নাই—জঙ্গলের আবর্জনায় যেথায় মুক্ত আলো ও বায়ুর পথ রুদ্ধ, যেথায় জ্ঞান নাই, বিদ্যা নাই, ধর্ম যেথায় বিকৃত, পথভ্রষ্ট, মৃতকল্প, জন্মভূমির সেই দুঃখের বিবরণ ছাপার অক্ষরেও পড়িয়াছি, নিজের চোখেও দেখিয়াছি; কিন্তু এই না-থাকা যে কত বড় না-থাকা, মনে হইল আজিকার পূর্বে তাহা যেন জানিতামই না। দেশের এই দৈন্য যে কিরূপ ভয়ঙ্কর দীনতা, আজিকার পূর্বে তাহার ধারণাই যেন আমার ছিল না।
শুষ্ক শূন্য বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্য দিয়া আমরা চলিয়াছি। পথের ধূলা শিশিরে ভিজিয়া ভারী হইয়াছে; তাহারই উপর দিয়া গাড়ির চাকা এবং গরুর ক্ষুরের শব্দ কদাচিৎ শোনা যায়, আকাশে জ্যোৎস্না পাণ্ডুর হইয়া যতদূর দৃষ্টি যায়, ছড়াইয়া পড়িয়াছে। ইহারই ভিতর দিয়া শীতের এই স্তব্ধ নিশীতে আমরা অজানার দিকে ধীর মন্থরগতিতে অবিশ্রাম চলিয়াছি।
অনুচরদিগের মধ্যে কে জাগিয়া, আর কে নাই, জানা গেল না,—সবাই শীতবস্ত্রে সর্বাঙ্গ আবৃত করিয়া নীরব। কেবল একা সন্ন্যাসী আমাদের সঙ্গ লইয়াছে এবং পরিপূর্ণ স্তব্ধতার মাঝে তাহারই মুখ দিয়া কেবল দেশের অজ্ঞাত ভাই-ভগিনীর অসহ্য বেদনার ইতিহাস যেন ঝলকে ঝলকে জ্বলিয়া জ্বলিয়া বাহির হইয়া আসিতেছে। এই সোনার মাটি কেমন করিয়া ধীরে ধীরে এমন শুষ্ক, এমন রিক্ত হইয়া উঠিল, কেমন করিয়া দেশের সমস্ত সম্পদ বিদেশীর হাত দিয়া ধীরে ধীরে বিদেশে চলিয়া গেল, কেমন করিয়া মাতৃভূমির সমস্ত মেদ-মজ্জা রক্ত বিদেশীরা শোষণ করিয়া লইল, চোখের উপর ইহার জ্বলন্ত ইতিহাস ছেলেটি যেন একটি একটি করিয়া উদ্ঘাটিত করিয়া দেখাইতে লাগিল।