কিন্তু আমি ত তাদের বাসাটা চিনিনে।
নীলিমা কহিল, ঠাকুরপো চেনেন। আমি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাব। তিনি তোমাদের মত ভীতু লোক নন।
একটু ভাবিয়া বলিল, তোমাদের মুখে যা শুনি তাতে শিবনাথবাবুরই দোষ,— তাঁকে ত আমি নেমত্যন্ন করতে চাইনে। আমি চাই কমলকে দেখতে, তার সঙ্গে আলাপ করতে! কমল যদি আসতে রাজী হয়, ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের স্ত্রী—তিনিও বলেচেন আসবেন। বুঝলে?
অবিনাশ বুঝিলেন সমস্তই, কিন্তু স্পষ্ট করিয়া সম্মতি দিতে পারিলেন না। অথচ বাধা দিতেও ভরসা পাইলেন না। নীলিমাকে তিনি শুধু স্নেহ ও শ্রদ্ধা করিতেন তাই নয়, মনে মনে ভয় করিতেন।
পরদিন সকালে হরেন্দ্রকে ডাকাইয়া আনিয়া নীলিমা কহিল, ঠাকুরপো, তোমাকে আর একটি কাজ করে দিতে হবে। তুমি আইবুড়ো মানুষ, ঘরে বৌ নেই যে সদাচারের নাম করে তোমার কান মলে দেবে। বাসায় ত থাকো, শুধু বাপ-মা-মরা একপাল ছাত্র নিয়ে,—তোমার ভয়টা কিসের?
হরেন্দ্র কহিল, ভয়ের কথা হবে পরে,—কিন্তু করতে হবে কি?
নীলিমা কহিল, কমলকে আমি দেখব, আলাপ করব, ঘরে এনে খাওয়াব। তুমি কি ওদের বাসা চেন? আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে তাকে নেমত্যন্ন করে আসতে হবে। কখন যেতে পারবে বল ত?
হরেন্দ্র বলিল, যখনই হুকুম করবেন। কিন্তু বাড়িওয়ালা? সেজদা? ওঁর অভিপ্রায়টা কি? এই বলিয়া সে বারান্দার ওধারে অবিনাশকে দেখাইয়া দিল। তিনি ইজিচেয়ারে শুইয়া পাইয়োনিয়ার পড়িতেছিলেন, শুনিতে পাইলেন সমস্তই, কিন্তু সাড়া দিলেন না।
নীলিমা বলিল, ওঁর অভিপ্রায় নিয়ে উনিই থাকুন, আমার কাজ নেই। আমি ওঁর শালী শালীর বোন নই যে পতি-পরম-গুরুর গদা ঘুরিয়ে শাসন করবেন। আমার যাকে ইচ্ছা খাওয়াব। ম্যাজিস্ট্রেটের বৌ বলেছেন খবর পেলে তিনিও আসবেন। ওঁর ভাল না লাগে তখন আর কোথাও গিয়ে যেন সময়টা কাটিয়ে আসেন।
অবিনাশ কাগজ হইতে মুখ না তুলিয়াই বলিলেন, কিন্তু কাজটা সমীচীন হবে না হরেন। কালকের ব্যাপারটা মনে আছে ত? আশুবাবুর মত সদাশিব ব্যক্তিকেও সাবধান হতে হয়।
হরেন্দ্র জবাব দিল না | এবং, পাছে সেই লজ্জাকর টাকার কথাটা উঠিয়া পড়ে এবং নীলিমার কানে যায়, সেই ভয়ে সে প্রসঙ্গটা তাড়াতাড়ি চাপা দিয়া বলিল, তার চেয়ে বরঞ্চ একটা কাজ করুন না বৌদি, আমার বাসাতে তাঁকে নিমন্ত্রণ করে আনুন। আপনি হবেন গৃহকর্ত্রী। লক্ষ্মীছাড়ার গৃহে একদিন লক্ষ্মীর আবির্ভাব হবে। আমার ছেলেগুলোও দুটো ভালোমন্দ জিনিস মুখে দিয়ে বাঁচবে।
নীলিমা অভিমানের সুরে বলিল, বেশ—তাই হোক ঠাকুরপো, আমিও ভবিষ্যতে খোঁটার জ্বালা থেকে নিস্তার পাব।
অবিনাশ উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, অর্থাৎ কেলেঙ্কারি তা হলে আর অবশিষ্ট থাকবে না। কারণ, শিবনাথকে বাদ দিয়ে শুধু তাকে তোমার বাসায় আহ্বান করে নিয়ে যাবার কোন কৈফিয়তই দেওয়া যাবে না। তার চেয়ে বরঞ্চ মেয়েরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হতে চান, এই ঢের ভাল শোনাবে।
কথাটা সত্যই যুক্তিসঙ্গত। তাই ইহাই স্থির হইল যে, কলেজের ছুটির পরে হরেন্দ্র গাড়ি করিয়া নীলিমাকে লইয়া গিয়া কমলকে নিমন্ত্রণ করিয়া আসিবে।
বৈকালে হরেন্দ্র আসিয়া জানাইল যে, কষ্ট করিয়া আর যাবার প্রয়োজন নাই। কাল রাত্রে খাবার কথা তাঁকে বলা হইয়াছে—তিনি রাজী হইয়াছেন।
নীলিমা উৎসুক হইয়া উঠিল। হরেন্দ্র কহিতে লাগিল, ফেরবার পথে হঠাৎ রাস্তার ওপরে দেখা। সঙ্গে মুটের মাথায় একটা মস্ত বাক্স। জিজ্ঞাসা করলাম, কি ওটা? কোথায় যাচ্চেন? বললেন, যাচ্চি একটু কাজে। তখন আপনার পরিচয় দিয়ে বললাম, বৌদি যে কাল সন্ধ্যার পরে আপনাকে নেমত্যন্ন করেচেন। নিতান্তই মেয়েদের ব্যাপার, যেতে হবে যে। একটুখানি চুপ করে থেকে বললেন, আচ্ছা। বললাম, কথা আছে আমাকে সঙ্গে নিয়ে বৌদি নিজে গিয়ে আপনাকে যথারীতি বলে আসবেন, কিন্তু তার আর প্রয়োজন আছে কি? একটুখানি হেসে বললেন, না। জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু একলা ত যেতে পারবেন না, কাল কখন এসে আপনাকে নিয়ে যাব? শুনে তেমনি হাসতে লাগলেন। বললেন, একলাই যেতে পারব,—অবিনাশবাবুর বাসা আমি চিনি।
নীলিমা আর্দ্র হইয়া কহিল, মেয়েটি এদিকে কিন্তু খুব ভাল। ভারী নিরহঙ্কার।
পাশের ঘরে অবিনাশ কাপড় ছাড়িতে ছাড়িতে সমস্ত কান পাতিয়া শুনিতেছিলেন, অন্তরাল হইতেই প্রশ্ন করিলেন, আর সেই মুটের মাথায় মোটা বাক্সটা? তার ইতিহাস ত প্রকাশ করলে না ভায়া?
হরেন্দ্র বলিল, জিজ্ঞাসা করিনি।
করলে ভাল করতে। বোধ হয় বিক্রি কিংবা বন্ধক দিতে যাচ্ছিলেন।
হরেন্দ্র কহিল, হতেও পারে। আপনার কাছে বন্ধক দিতে এলে ইতিহাসটা জেনে নেবেন। এই বলিয়া সে চলিয়া যাইতেছিল, হঠাৎ দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া ডাকিয়া কহিল, বৌদি, আপনাদের নারী-কল্যাণ-সমিতিতে অক্ষয়ের প্রবন্ধ শুনেছেন ত? আমরা লোকটাকে ব্রুট্ বলি। কিন্তু, ও বেচারার আর একটুখানি ভণ্ডামি বুদ্ধি থাকলে সমাজে অনায়াসেই সাধু-সজ্জন বলে চলে যেতে পারত—কি বলেন সেজদা? ঠিক না?
অবিনাশ ঘরের মধ্যে হইতে গর্জন করিয়া উঠিলেন—হ্যাঁ হে, নিত্যানন্দ-শ্রীগৌরাঙ্গমহাপ্রভু! এ বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। বন্ধুবরকে কৌশলটা শিখিয়ে দাও গে যাও।
চেষ্টা করব। কিন্তু চললাম বৌদি, কাল আবার যথাসময়ে হাজির হব। এই বলিয়া সে প্রস্থান করিল।
নীলিমা উদ্যোগ-আয়োজনের ত্রুটি রাখে নাই। মনোরমা গোড়া হইতেই কমলের অত্যন্ত বিরুদ্ধে—সে কোনমতেই আসিবে না জানিয়া আশুবাবুদের কাহাকেও বলা হয় নাই। মালিনীকে খবর পাঠান হইয়াছিল, কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হইয়া পড়ায় তিনি আসিলেন না।