আশুবাবু ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, খবর পেলে?
অজিত কহিল, গাড়ি-ঘোড়া আস্তাবলেই আছে। মণি বাইরে যাননি।
বাঁচালে বাবা। এই বলিয়া আশুবাবু নিশ্চিন্ত পরিতৃপ্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, রাত অনেক হল, সে বোধ হয় ক্লান্ত হয়ে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েচে। আজ আর দেখিচি মেয়েটার খাওয়া হল না। যাও বাবা, তুমি দুটি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো গে।
অজিত বলিল, এত রাত্রে আমি আর খাবো না, আপনি শুতে যান।
যাই। কিন্তু কিছুই খাবে না? একটু কিছু মুখে দিয়ে—
না, কিছুই না। আপনি আর বিলম্ব করবেন না। শুতে যান।
এই বলিয়া সেই রুগ্ন মানুষটিকে ঘরে পাঠাইয়া দিয়া অজিত নিজের ঘরে আসিয়া খোলা জানালার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিল। সে নিশ্চয় জানিত সুরের আলোচনা শেষ হইলে পিতার খবর লইতে এদিকে একবার মনোরমা আসিবেই আসিবে।
মণি আসিল, কিন্তু প্রায় আধ-ঘণ্টা পরে। প্রথমে সে পিতার বসিবার ঘরের সম্মুখে গিয়া দেখিল ঘর অন্ধকার। যদু বোধ হয় নিকটেই কোথাও সজাগ ছিল, মনিবের ডাকে সাড়া দেয় নাই বটে, কিন্তু তিনি উঠিয়া গেলে আলো নিবাইয়া দিয়াছিল। মনোরমা ক্ষণকাল ইতস্ততঃ করিয়া মুখ ফিরাইতেই দেখিতে পাইল অজিত তাহার খোলা জানালার সম্মুখে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহারো ঘরে আলো ছিল না, কিন্তু উপরের গাড়িবারান্দার ক্ষীণ রশ্মিরেখা তাহার জানালায় গিয়া পড়িয়াছিল।
কে?
আমি অজিত।
বাঃ! কখন এলে? বাবা বোধ হয় শুতে গেছেন। এই বলিয়া সে যেন একটু চুপ করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু অসমাপ্ত কথার বেগ তাহাকে থামিতে দিল না। বলিতে লাগিল, দ্যাখো ত তোমার অন্যায়। বাড়িসুদ্ধ লোক ভেবে সারা,—নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছিল। তাই ত বাবা বার বার বারণ করেন একলা যেতে।
এই-সকল প্রশ্ন ও মন্তব্যের অজিত একটারও জবাব দিল না।
মনোরমা কহিল, কিন্তু তিনি কখনই ঘুমুতে পারেন নি। নিশ্চয় জেগে আছেন। তাঁকে একটা খবর দিই গে।
অজিত কহিল, দরকার নেই। তিনি আমাকে দেখেই তবে শুতে গেছেন।
দেখেই শুতে গেছেন? তবে আমাকে একটা খবর দিলে না কেন?
তিনি মনে করেছিলেন তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ।
ঘুমিয়ে পড়ব কি রকম? এখনো ত আমার খাওয়া হয়নি পর্যন্ত।
তা হলে খেয়ে শোও গে। রাত আর নেই।
তুমি খাবে না?
না। এই বলিয়া অজিত জানালা হইতে সরিয়া গেল।
বাঃ! বেশ ত কথা! ইহার অধিক কথা তাহার মুখে ফুটিল না। কিন্তু ভিতর হইতেও আর জবাব আসিল না। বাহিরে একাকী মনোরমা স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। পীড়াপীড়ি করিয়া, রাগ করিয়া, নিজের জিদ বজায় রাখিতে তাহার জোড়া নাই,—এখন কিসে যেন তাহার মুখ আঁটিয়া বন্ধ করিয়া রাখিল। অজিত রাত্রি শেষ করিয়া গৃহে ফিরিয়াছে,—বাড়িসুদ্ধ সকলের দুশ্চিন্তার অন্ত নাই,—এতবড় অপরাধ করিয়াও সে-ই তাহাকে অপমানের একশেষ করিল, কিন্তু এতটুকু প্রতিবাদের ভাষাও তাহার মুখে আসিল না, এবং শুধু কেবল জিহ্বাই নির্বাক নয়, সমস্ত দেহটাই যেন কিছুক্ষণের মত বিবশ হইয়া রহিল, জানালায় কেহ ফিরিয়া আসিল না, সে রহিল কি গেল এটুকু জানারও কেহ প্রয়োজন বোধ করিল না। গভীর নিশীথে এমনি নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া মনোরমা বহুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।
সকালেই বেহারার মুখে আশুবাবু খবর পাইলেন কাল অজিত কিংবা মনোরমা কেহই আহার করে নাই। চা খাইতে বসিয়া তিনি উৎকণ্ঠার সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, কাল তোমার নিশ্চয়ই ভয়ানক কিছু একটা এ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছিল, না?
অজিত বলিল, না।
তবে নিশ্চয় হঠাৎ তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল?
না, তেল যথেষ্ট ছিল।
তবে এত দেরি হল যে?
অজিত শুধু কহিল, এমনিই।
মনোরমা নিজে চা খায় না। সে পিতাকে চা তৈরি করিয়া দিয়া একবাটি চা ও খাবারের থালাটা অজিতের দিকে বাড়াইয়া দিল, কিন্তু প্রশ্নও করিল না, মুখ তুলিয়াও চাহিল না। উভয়ের এই ভাবান্তর পিতা লক্ষ্য করিলেন। আহার শেষ করিয়া অজিত স্নান করিতে গেলে তিনি কন্যাকে নিরালায় পাইয়া উদ্বিগ্ন-কণ্ঠে কহিলেন, না মা, এটা ভাল নয়। অজিতের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ যত ঘনিষ্ঠই হোক, তবুও এ-বাড়িতে তিনি অতিথি। অতিথির যোগ্য মর্যাদা তাঁকে দেওয়া চাই।
মনোরমা কহিল, দেওয়া চাইনে এ কথা ত আমি বলিনি বাবা!
না না, বলনি সত্যি, কিন্তু আমাদের আচরণে কোনরূপ বিরক্তি প্রকাশ পাওয়াও অপরাধ।
মনোরমা বলিল, তা মানি। কিন্তু আমার আচরণে অপরাধ হয়েছে এ তুমি কার কাছে শুনলে?
আশুবাবু, এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারিলেন না। তিনি শোনেন নি কিছুই, জানেন না কিছুই, সমস্তই তাঁহার অনুমান মাত্র। তথাপি মন তাঁহার প্রসন্ন হইল না। কারণ, এমন করিয়া তর্ক করা যায়, কিন্তু উৎকণ্ঠিত পিতৃ-চিত্তকে নিঃশঙ্ক করা যায় না। খানিক পরে তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, অত রাত্রে অজিত আর খেতে চাইলেন না, আমিও শুতে গেলাম; তুমি ত আগেই শুয়ে পড়েছিলে—কি জানি, কোথায় হয়ত আমাদের একটা অবহেলা প্রকাশ পেয়েছে। ওঁর মনটা আজ তেমন ভাল নেই।
মনোরমা বলিল, কেউ যদি সারা রাত পথে কাটাতে চায়, আমাদেরও কি তার জন্যে ঘরের মধ্যে জেগে কাটাতে হবে? এই কি অতিথির প্রতি গৃহস্থের কর্তব্য বাবা?
আশুবাবু হাসিলেন। নিজেকে ইঙ্গিতে দেখাইয়া বলিলেন, গৃহস্থ মানে যদি এই বেতো রুগীটি হয় মা, তা হলে তাঁর কর্তব্য আটটার মধ্যেই শুয়ে পড়া। নইলে ঢের বড় সম্মানিত অতিথি বাত-ব্যাধির প্রতি অসম্মান দেখানো হয়। কিন্তু সে অর্থে যদি অন্য কাউকে বোঝায় ত তাঁর কর্তব্য নির্দেশ করবার আমি কেউ নয়। আজ অনেকদিনের একটা ঘটনা মনে পড়ল মণি। তোমার মা তখন বেঁচে। গুপ্তিপাড়ায় মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরতে পারলাম না। শুধু একটা রাত মাত্রই নয়, তবু একজন তাই নিয়ে গোটা তিনটে রাত্রি জানালায় বসে কাটিয়ে দিলেন। তাঁর কর্তব্য কে নির্দেশ করেছিলেন তখন জিজ্ঞেসা করা হয়নি, কিন্তু আর একদিন দেখা হলে এ কথা জেনে নিতে ভুলবো না। এই বলিয়া তিনি ক্ষণকালের জন্য মুখ ফিরাইয়া কন্যার দৃষ্টিপথ হইতে নিজের চোখ-দুটিকে আড়াল করিয়া লইলেন।