আহারান্তে অক্ষয় কমলকে একমুহূর্ত নিরালায় পাইয়া চুপি চুপি বলিল, শুনতে পেলাম আপনারা চলে যাচ্চেন। পরিচিত সকলের বাড়িতেই আপনি এক-আধবার গেছেন,শুধু আমারই ওখানে—
আপনি! কমল অতিমাত্রায় বিস্মিত হইল। শুধু কণ্ঠস্বরের পরিবর্তনে নয়,‛তুমি’ বলিয়া তাহাকে সবাই ডাকে, সে অভিযোগও করে না, অভিমানও করে না। কিন্তু অক্ষয়ের অন্য কারণ ছিল। এই স্ত্রীলোকটিকে ‛আপনি’ বলাটা সে বাড়াবাড়ি, এমন কি ভদ্র-আচরণের অপব্যবহার বলিয়াই মনে করিত। কমল ইহা জানিত। কিন্তু এই অতি ক্ষুদ্র ইতরতায় দৃকপাত করিতেও তাহার লজ্জা করিত। পাছে একটা তর্কাতর্কি কলহের বিষয় হইয়া উঠে এই ছিল তার ভয়। হাসিয়া বলিল, আপনি ত কখনো যেতে বলেন নি।
না। সেটা আমার অন্যায় হয়েছে। চলে যাবার আগে কি আর সময় হবে না?
কি করে হবে অক্ষয়বাবু, আমরা যে কাল ভোরেই যাচ্চি।
ভোরেই? একটু থামিয়া বলিল, এ অঞ্চলে যদি কখনো আসেন আমার গৃহে আপনার নিমন্ত্রণ রইল।
কমল হাসিয়া কহিল, একটা কথা জিজ্ঞেসা করতে পারি অক্ষয়বাবু? হঠাৎ আমার সম্বন্ধে আপনার মত বদলালো কি করে? বরঞ্চ, আরও ত কঠোর হবারই কথা।
অক্ষয় কহিল, সাধারণতঃ তাই হতো বটে। কিন্তু এবার দেশ থেকে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। আপনার ঐ পিউরিটানদের দৃষ্টান্ত আমার ভেতরে গিয়ে লেগেছে। আর কেউ বুঝলেন কিনা জানিনে—না বোঝাও আশ্চর্যি নয়—কিন্তু আমি অনেক কথাই জানি। আর একটা কথা। আমাদের গ্রামের প্রায় চোদ্দ-আনা মুসলমান, ওরা ত সেই দেড়-হাজার বছরের পুরনো সত্যেই আজও দৃঢ় হয়ে আছে। সেই বিধি-নিষেধ, আইন-কানুন, আচার-অনুষ্ঠান,—কিছুই ত ব্যত্যয় হয়নি।
কমল কহিল, ওঁদের সম্বন্ধে আমি প্রায় কিছুই জানিনে, জানবার কখনো সুযোগও হয়নি। যদি আপনার কথাই সত্যি হয় ত কেবল এইটুকুই বলতে পারি যে, ওঁদেরও ভেবে দেখবার দিন এসেছে। সত্যের সীমা যে কোন-একটা অতীত দিনেই সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়নি, এ সত্য ওঁদেরও একদিন মানতে হবে। কিন্তু উপরে চলুন।
না,আমি এখান থেকেই বিদায় নেবো। আমার স্ত্রী পীড়িত। এত লোককে দেখেছেন, একবার তাঁকে দেখবেন না?
কমল কৌতূহলবশতঃ জিজ্ঞাসা করিল, তিনি কেমন দেখতে?
অক্ষয় কহিল, ঠিক জানিনে। আমাদের পরিবারে ও প্রশ্ন কেউ করে না। বিয়ে দিয়ে ন’বছরের মেয়েকে বাবা ঘরে এনেছিলেন। লেখাপড়া শেখবারও সময় পায়নি, দরকারও হয়নি। রাঁধাবাড়া, বার-ব্রত, পূজো-আহ্নিক নিয়ে আছে; আমাকেই ইহকাল-পরকালের দেবতা বলে জানে, অসুখ হলে ওষুধ খেতে চায় না, বলে,স্বামীর পাদোদকেই সকল ব্যামো সারে। যদি না সারে, বুঝবে স্ত্রীর আয়ু শেষ হয়েছে।
ইহার একটুখানি আভাস কমল হরেন্দ্রের কাছে শুনিয়াছিল, কহিল, আপনি ত ভাগ্যবান, অন্ততঃ স্ত্রী-ভাগ্যে। এতখানি বিশ্বাস এ যুগে দুর্লভ।
অক্ষয় কহিল, বোধ হয় তাই, ঠিক জানিনে। হয়ত, একেই স্ত্রী-ভাগ্য বলে। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় যেন আমার কেউ নেই, সংসারে আমি একেবারে নিঃসঙ্গ একা।আচ্ছা, নমস্কার।
কমল হাত তুলিয়া নমস্কার করিল।
অক্ষয় এক পা গিয়াই ফিরিয়া দাঁড়াইল,বলিল, একটা অনুরোধ করব?
করুন।
যদি কখনো সময় পান, আর আমাকে মনে থাকে, একখানা চিঠি লিখবেন? আপনি নিজে কেমন আছেন, অজিতবাবু কেমন আছেন,—এই সব। আপনাদের কথা আমি প্রায়ই ভাববো। আচ্ছা, চললাম,—নমস্কার! এই বলিয়া অক্ষয় দ্রুত প্রস্থান করিল। এবং সেইখানে কমল স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ভাল-মন্দর বিচার করিয়া নয়, শুধু এই কথাই তাহার মনে হইল যে, এই সেই অক্ষয়! এবং মানুষের জানার বাহিরে এইভাবে এই ভাগ্যবানের দাম্পত্য-জীবন নির্বিঘ্ন শান্তিতে বহিয়া চলিয়াছে! একখানি চিঠির জন্য তাহার কি কৌতূহল, কি সকাতর সত্যকার প্রার্থনা!
উপরে আসিয়া দেখিল নীলিমা ব্যতীত সবাই যথাস্থানে উপবিষ্ট। এ তাহার স্বভাব,—বিশেষ কেহ কিছু মনে করে না। আশুবাবু বলিলেন, হরেন্দ্র একটি চমৎকার কথা বলছিলেন কমল। শুনলে হঠাৎ হেঁয়ালি বলে ঠেকে, কিন্তু বস্তুতঃই সত্য। বলছিলেন, লোকে এইটিই বুঝতে পারে না যে, প্রচলিত সমাজ-বিধি লঙ্ঘন করার দুঃখ শুধু চরিত্র-বল ও বিবেকবুদ্ধির জোরেই সহা যায়। মানুষে বাইরের অন্যায়টাই দেখে, অন্তরের প্রেরণার খবর রাখে না। এইখানেই যত দ্বন্দ্ব, যত বিরোধের সৃষ্টি।
কমল বুঝিল, ইহার লক্ষ্য সে এবং অজিত। সুতরাং চুপ করিয়া রহিল। এ কথা বলিল না যে, উচ্ছৃঙ্খলতার জোরেও সমাজ-বিধি লঙ্ঘন করা যায়। দুর্বুদ্ধি ও বিবেক-বুদ্ধি এক পদার্থ নয়।
বেলা ও মালিনী উঠিয়া দাঁড়াইল, তাহাদের যাবার সময় হইয়াছে। কমলকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া তাহারা হরেন্দ্র ও আশুবাবুকে নমস্কার করিল। এই মেয়েটির সম্মুখে সর্বক্ষণই তাহারা নিজেদের ছোট মনে করিয়াছে, শেষবেলায় তাহার শোধ দিল উপেক্ষা দেখাইয়া। চলিয়া গেলে আশুবাবু সস্নেহে কহিলেন, কিছু মনে করো না মা, এ ছাড়া ওঁদের আর হাতে কিছু নেই। আমিও তো ওই দলের লোক। সবই জানি।
আশুবাবু হরেন্দ্রের সাক্ষাতে আজ এই প্রথম তাহাকে মা বলিয়া ডাকিলেন। কহিলেন, দৈবাৎ ওঁরা পদস্থ ব্যক্তিদের ভার্যা। হাই-সার্কেলের মানুষ। ইংরিজি বলা-কওয়া, চলা-ফেরা, বেশভূষায় আপ্-টু-ডেট। এটুকু ভুললে যে ওঁদের একেবারে পুঁজিতে ঘা পড়ে, কমল। রাগ করলেও ওঁদের প্রতি অবিচার হয়।