কথা-কয়টি সামান্য, কিন্তু ওই শান্ত, সহৃদয় প্রৌঢ় ব্যক্তিটির মুখের দিকে চাহিয়া সকলেরই হৃদয় স্পর্শ করিল।
আশুবাবু সঙ্কোচ বোধ করিলেন। বাক্যালাপ তাহাকে অবলম্বন করিয়া না প্রবর্তিত হয় এই আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি নিজেই অন্য কথা পাড়িলেন, বলিলেন, অক্ষয়, খবর পেয়েছ বোধ হয় হরেন্দ্রর ব্রহ্মচর্য আশ্রমটা আর নেই। রাজেন্দ্র আগেই বিদায় নিয়েছিলেন, সেদিন সতীশও গেছেন। যে-ক’টি ছেলে বর্তমানে আছে, হরেন্দ্রর অভিলাষ জগতের সোজা-পথেই তাদের মানুষ করে তোলেন। তোমরা সকলে অনেকদিন অনেক কথাই বলেছ, কিন্তু ফল হয়নি। তোমাদের কর্তব্য কমলকে ধন্যবাদ দেওয়া।
অক্ষয় অন্তরে জ্বলিয়া গিয়া শুষ্ক হাসিয়া বলিল, শেষকালে ফল ফলল বুঝি ওর কথায়? কিন্তু যাই বলুন আশুবাবু, আমি আশ্চর্য হয়ে যাইনি। এইটি অনেক পূর্বেই অনুমান করেছিলাম।
হরেন্দ্র কহিল, করবেনই ত। মানুষ চেনাই যে আপনার পেশা।
আশুবাবু বলিলেন, তবুও আমার মনে হয় ভাঙবার প্রয়োজন ছিল না। সকল ধর্মমতই ত মূলতঃ এক, সিদ্ধিলাভের জন্য এ কেবল কতকগুলি প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান প্রতিপালন করে চলা। যারা মানে না বা পারে না, তারা না-ই পারল, কিন্তু পারার অধ্যবসায় যাদের আছে তাদের নিরুৎসাহ করেই বা লাভ কি? কি বল অক্ষয়?
অক্ষয় কহিল, নিশ্চয়।
কমলের দিকে চাহিতেই সে সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, আপনার ত এ দৃঢ় বিশ্বাসের কথা হলো না আশুবাবু, বরঞ্চ, হলো অবিশ্বাস অবহেলার কথা। এমন করে ভাবতে পারলে আমিও আশ্রমের বিরুদ্ধে একটা কথাও কখনো বলতাম না। কিন্তু তা ত নয়—আচার-অনুষ্ঠানই যে মানুষের ধর্মের চেয়েও বড়,—যেমন বড় রাজার চেয়ে রাজার কর্মচারীর দল।
আশুবাবু সহাস্যে কহিলেন, তা যেন হলো, কিন্তু তাই বলে কি তোমার উপমাকেই যুক্তি বলে মেনে নেবো?
কমল পরিহাস যে করে নাই তাহার মুখ দেখিয়াই বুঝা গেল। কহিল, শুধুই কি এ উপমা আশুবাবু, তার বেশী নয়? সকল ধর্মই যে আসলে এক, এ আমি মানি। সর্বকালে, সর্বদেশে ও-সেই এক অজ্ঞেয় বস্তুর অসাধ্য সাধনা। মুঠোর মধ্যে ওকে ত পাওয়া যায় না। আলো-বাতাস নিয়ে মানুষের বিবাদ নেই, বিবাদ বাধে অন্নের ভাগাভাগি নিয়ে,—যাকে আয়ত্তে পাওয়া যায়, দখল করে বংশধরের জন্যে রেখে যাওয়া চলে। তাই ত জীবনের প্রয়োজনে ও ঢের বড় সত্যি। বিবাহের মূল উদ্দেশ্য যে সকল ক্ষেত্রেই এক, এ ত সবাই জানে, কিন্তু তাই বলে কি মানতে পারে? আপনিই বলুন না অক্ষয়বাবু, ঠিক কি না। এই বলিয়া সে হাসিয়া মুখ ফিরাইল।
ইহার নিহিত অর্থ সবাই বুঝিল। ক্রুদ্ধ অক্ষয় কঠোর কিছু একটা বলিতে চাহিল, কিন্তু কথা খুঁজিয়া পাইল না।
আশুবাবু বলিলেন, অথচ তোমারই যে কমল, সকল আচার-অনুষ্ঠানেই ভারী অবজ্ঞা, কিছুই যে মানতে চাও না? তাই ত তোমাকে বোঝা এত শক্ত।
কমল বলিল, কিছুই শক্ত নয়। একটিবার সামনের পর্দাটা সরিয়ে দিন, আর কেউ না বুঝুক, আপনার বুঝতে বিলম্ব হবে না। নইলে, আপনার স্নেহই বা আমি পেতাম কি করে? মাঝখানে কুয়াশার আড়াল যে নেই তা নয়, কিন্তু তবু ত পেলাম। আমি জানি, আপনার ব্যথা লাগে, কিন্তু আচার-অনুষ্ঠানকে মিথ্যে বলে আমি উড়িয়ে দিতে ত চাইনে, চাই শুধু এর পরিবর্তন। কালের ধর্মে আজ যা অচল, আঘাত করে তাকে সচল করতেই চাই। এই যে অবজ্ঞা, মূল্য এর জানি বলেই ত। মিথ্যে বলে জানলে মিথ্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মিথ্যে-শ্রদ্ধায় সকলের সঙ্গে সারাজীবন মেনে মেনেই চলতাম—একটুও বিদ্রোহ করতাম না।
একটু থামিয়া কহিল, ইউরোপের সেই রেনেশাঁসের দিনগুলো একবার মনে করে দেখুন দিকি। তারা সব করতে গেল নতুন সৃষ্টি, শুধু হাত দিলে না আচার-অনুষ্ঠানে। পুরনোর গায়ে টাটকা রঙ মাখিয়ে তলে তলে দিতে লাগল তার পূজো, ভেতরে গেল না শেকড়, শখের ফ্যাশন গেল দু’দিনে মিলিয়ে। ভয় ছিল আমার হরেনবাবুর উচ্চ অভিলাষ যায় বা বুঝি এমনি করেই ফাঁকা হয়ে। কিন্তু আর ভয় নেই, উনি সামলেছেন। এই বলিয়া সে হাসিল।
এ হাসিতে হরেন্দ্র যোগ দিতে পারিল না, গম্ভীর হইয়া রহিল। কাজটা সে করিয়াছে সত্য, কিন্তু অন্তরে ঠিকমত আজও সায় পায় না, মনের মধ্যেটা রহিয়া রহিয়া ভারী হইয়া উঠে। কহিল, মুশকিল এই যে, তুমি ভগবান মানো না, মুক্তিতেও বিশ্বাস কর না। কিন্তু যারা তোমার ওই অজ্ঞেয় বস্তুর সাধনায় রত, ওর তত্ত্ব-নিরূপণে ব্যগ্র, তাদের কঠিন নিয়ম ও কঠোর আচার-পালনের মধ্যে দিয়ে পা না ফেললেই নয়। আশ্রম তুলে দেওয়ায় আমি অহঙ্কার করিনে। সেদিন যখন ছেলেদের নিয়ে সতীশ চলে গেল আমি নিজের দুর্বলতাই অনুভব করেছি।
তা হলে ভাল করেন নি হরেনবাবু। বাবা বলতেন, যাদের ভগবান যত সূক্ষ্ম, যত জটিল, তারাই মরে তত বেশী জড়িয়ে। যাদের যত স্থূল, যত সহজ, তারাই থাকে কিনারার কাছে। এ যেন লোকসানের কারবার। ব্যবসা হয় যতই বিস্তৃত ও ব্যাপক, ক্ষতির পরিমাণ ততই চলে বেড়ে। তাকে গুটিয়ে ছোট করে আনলেও লাভ হয় না বটে, কিন্তু লোকসানের মাত্রা কমে। হরেনবাবু, আপনার সতীশের সঙ্গে আমি কথা কয়ে দেখেচি। আশ্রমে বহুবিধ প্রাচীন নিয়মের তিনি প্রবর্তন করেছিলেন, তাঁর সাধ ছিল সে-যুগে ফিরে যাওয়া। ভাবতেন, দুনিয়ার বয়স থেকে হাজার-দুই বছর মুছে ফেললেই আসবে পরম লাভ। এমনি লাভের ফন্দি এঁটেছিল একদিন বিলাতের পিউরিটান একদল। ভেবেছিল, আমেরিকায় পালিয়ে গিয়ে সতেরো শতাব্দী ঘুচিয়ে দিয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে গড়ে তুলবে বাইবেলের সত্যযুগ। তাদের লাভের হিসাবের অঙ্ক জানে আজ অনেকে, জানে না শুধু মঠধারীর দল যে, বিগত দিনের দর্শন দিয়ে চলে যখন বর্তমানের বিধি-বিধানের সমর্থন, তখনই আসে সত্যিকারের ভাঙ্গার দিন। হরেনবাবু, আপনার আশ্রমের ক্ষতি হয়ত করেচি, কিন্তু ভাঙ্গা আশ্রমে বাকী রইলেন যাঁরা তাদের ক্ষতি করিনি।