জয়াবতী অপ্রতিভ হইল। কথাটার যে আরো একটু অন্যরূপ মানে হইতে পারে তাহা সে ততটা ভাবিয়া বলে নাই, বলিল, ছিঃ! ওকথা কি বলে?
মালতী চুপ করিয়া রহিল, আর উত্তর করিল না। নিঃশব্দে সে ভাবিয়া দেখিতেছিল যে, জয়াবতীর কথা সত্য হইলে কেমন হয়? ভাল হয় কি? হয় না। মরিতে তাহার সাধ নাই। তাহাকে ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করিলে বলিবে যে, সে মরণের অধিক ক্লেশ পাইতেছে, তথাপি মরিতে পারিবে না; মরণে ভয় নাই, তথাপি মরিবার ইচ্ছা নাই। যাহারা সে ইচ্ছা করিতে পারে তাহাদের দুঃখ তত অধিক নয়। একবিন্দু জল তাহার চক্ষু দিয়া গড়াইয়া পড়িল।
জয়াবতী সস্নেহে তাহা মুছাইয়া বলিল, ভাব কেন বোন? পূবে বাতাস লেগে একটু গা গরম হয়েচে, তাই বলে কি ভাবতে হয়? তাহার পর একটু থামিয়া একটু চিন্তা করিয়া সাবধান হইয়া বলিল, আর যদি তেমন তেমন হয় তা হলেও ত উপায় আছে, কাছেই কলকাতা—সেখানে ডাক্তার-বদ্দির অভাব কি?
অভাব কিছুরই ছিল না এবং প্রয়োজনও কিছুই হইল না। বজরা যেদিন কলিকাতা আসিয়া পঁহুছিল সেদিন মালতীর আর জ্বর ছিল না, কিন্তু শরীর বড় দুর্বল, এখনো কিছুই খাইতে পায় নাই। বজরা কলিকাতা ছাড়াইয়া একটু দূরে—পরপারে নোঙ্গর করা হইল। কামরার জানালা খোলা ছিল, মুখ বাড়াইয়া মালতী জাহাজ, মাস্তুল, বড় বড় নৌকা ও প্রাসাদতুল্য প্রকাণ্ড অট্টালিকা-শ্রেণীর চূড়া দেখিতে লাগিল। মালতীর ভয় হইতেছিল; ভাবিতেছিল এই কি কলিকাতা? তাহা হইলে এত গণ্ডগোলে, এত শব্দসাড়ার মধ্যে কে তাহার কথা শুনিতে পাইবে? এত ব্যস্ত শহরে কে তাহাকে দেখিবার অবকাশ পাইবে? কিন্তু তাহা ত হইবে না, তাহাকে যাইতেই হইবে। যেজন্য এ অসমসাহসিক কাজ করিয়া ফেলিয়াছে, যাহাদের মুখ মনে করিয়া নরকে ডুব দিতে বসিয়াছে—ইহকাল পরকাল কোন কথাই মনে স্থান দেয় নাই, তাহাদের মুখ এত শীঘ্র ভুলিতে পারিবে না। আজ না হয় কাল এ আশ্রয় পরিত্যাগ করিতেই হইবে; আর যখন হইবেই তখন আর ভয় করিয়া লাভ কি?
সে যাইতে কৃতসঙ্কল্প হইল, কিন্তু সুরেন্দ্রবাবু প্রচার করিলেন যে, বজরা এস্থানে আরও তিন-চারিদিন বাঁধা থাকিবে। মালতীর শরীর রীতিমত সুস্থ হইলে তবে সে যেখানে ইচ্ছা যাইবে; বজরাও সেইসময়ে খোলা হইবে। মালতী একথা শুনিয়া মনে মনে তাঁহাকে সহস্র ধন্যবাদ দিল। আন্তরিক সে ইহাই প্রার্থনা করিতেছিল; কেননা, যতই প্রয়োজনীয় এবং কর্তব্য হউক না, আশ্রয় ত্যাগ করিয়া নিরাশ্রয়ে যাইতে মনকে তেমন সহজে রাজী করিতে পারা যায় না, ইতিপূর্বেই সে এই মর্মে তাহার সহিত কলহ করিতেছিল—এখন যেন নিঃশ্বাস ফেলিয়া সেটাকে বুঝাইয়া সুঝাইয়া চলনসই গোছ একরকম করিয়া লইবার মত সময় পাইল।
পরদিন মধ্যাহ্নে জয়াবতী কলিকাতা ভ্রমণ করিতে যাইবে স্থির হইয়াছিল। গাড়ি, পান্সি ঠিক করিয়া ভৃত্য সংবাদ দিল; জয়াবতী বাবুকে তাহার সহিত যাইতে অনেক সাধ্যসাধনা করিল, কিন্তু তিনি কিছুতেই সম্মত হইলেন না! মালতী যাইতে চাহিয়াছিল, কিন্তু বাবু নিষেধ করিয়া পাঠাইলেন—তাহার শরীর ভাল নয়, আবার জ্বর হইতে পারে। তখন অগত্যা জয়াবতী একাই দাসী ভৃত্য সঙ্গে লইয়া বেড়াইতে গেল।
মালতী কামরার ভিতর শয়ন করিয়াছিল, সুরেন্দ্রবাবু দ্বার ঠেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। মালতী সঙ্কুচিত হইয়া উঠিয়া বসিল, সুরেন্দ্রবাবু একটু দূরে উপবেশন করিলেন—অনেকক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত হইল। তিনি কিছু বলিবেন মনে করিয়া আসিয়াছিলেন, কিন্তু বলিতে সাহস হইতেছিল না—অনেকক্ষণ পরে একটু থামিয়া একটু ভাবিয়া বলিলেন, তুমি এইখানেই কি নিশ্চয় নামিয়া যাইবে?
মাথা নাড়িয়া মালতী বলিল, হাঁ।
বেশ করিয়া চিন্তা করিয়া দেখিয়াছ কি?
মালতী সেইরূপভাবে বলিল, দেখিয়াছি।
কোথায় যাইবে?
তা ত জানি না।
সুরেন্দ্রবাবু হাসিয়া উঠিলেন; বলিলেন, তবে আর কি দেখিয়াছ? আজ নয়, কাল একবার কলিকাতার ভিতরটা দেখিয়া আসিও; তাহার পর যদি নিশ্চিত ত্যাগ করিয়া অনিশ্চিতই ভাল লাগে—যাইও, আমি বারণ করিব না।
মালতী কথা কহিল না।
তিনিও কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া পুনরায় পূর্বাপেক্ষা ম্লানভাবে কহিতে লাগিলেন, তুমি যতটা না ভাবিয়াছ, আমি ততটা ভাবিয়া দেখিয়াছি। তুমি ব্রাহ্মণকন্যা—হীনবৃত্তি করিতে পারিবে না; ভদ্রলোকের কন্যা ভদ্রসংসারে প্রবেশ করিতে না পারিলে তুমি থাকিতে পারিবে না; এ অবস্থায় নিঃসহায় কেমন করিয়া যে এত বড় শহরে সমস্ত অনুসন্ধান করিয়া লইতে পারিবে, আমি বুঝিতে পারি না। কিছুক্ষণ থামিয়া আবার কহিলেন, ভাবিয়া দেখ, তোমার এ বয়সে মানসম্ভ্রম বজায় রাখিয়া আপনাকে সামলাইয়া চলিতে পারিবে কি? ভয় হয় পাছে পদে পদে বিপদে পড়।
মালতী নিঃশব্দে কাঁদিতেছিল, এসকল সে সমস্তই ভাবিয়া দেখিয়াছিল, কিন্তু উপায় ছিল না, তাহা পূর্বেই বলিয়াছি।
সুরেন্দ্রবাবু বুঝিলেন, মালতী কাঁদিতেছে, পূর্বেও তাহাকে কাঁদিতে দেখিয়াছিলেন, কিন্তু এখন অন্যরূপ মনে হইতে লাগিল; বলিলেন, যাওয়াই কি স্থির করিলে?
মালতী চোখ মুছিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ।
নারায়ণপুরের জমিদার শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রবাবুকে অনেকেই বোকা মনে করিত, কিন্তু বস্তুতঃ তিনি তাহা ছিলেন না। যাহারা তাঁহাকে এ আখ্যা প্রদান করিত তাহাদের অপেক্ষাও তিনি বোধ হয় শতগুণ অধিক বুদ্ধিমান ছিলেন, কিন্তু অনেক সময়ে তিনি দুর্বল প্রকৃতির লোকের মত কর্ম করিতেন, এইজন্য তাঁহাকে সহজে বুঝিতে পারা যাইত না। মালতীর মনের কথা তিনি ধরিয়া ফেলিলেন, মনে মনে একটু হাসিলেন, তাহার পর মালতী অপেক্ষাকৃত সুস্থ হইলে বলিলেন, মালতী, তোমার বড় টাকার প্রয়োজন, না?