স্ত্রীলোকটি বলিল, আমি বলতে পারি না। বোধ হয় নাই।
তবে তুমি এখানে কোথা হতে এলে?
স্ত্রীলোকটি চুপ করিয়া রহিল।
তোমার বাড়ি কি নিকটেই?
না; অনেক দূর।
তবে এখানে কেন?
আমাদের নৌকা ডুবিয়া গিয়াছিল।
কবে?
কাল রাত্রে।
তোমার সঙ্গীরা কোথায়?
বলিতে পারি না।
তুমি এতক্ষণ ধরিয়া জলে দাঁড়াইয়া আছ কেন? নিকটবর্তী কোন গ্রাম অনুসন্ধান কর নাই কেন?
সে পুনর্বার চুপ করিয়া রহিল।
সুরেন্দ্রবাবু কথার উত্তর না পাইয়া বলিলেন, তোমার বাড়ি এখান হইতে কতদূরে হইবে?
প্রায় দশ-বারো ক্রোশ।
কোন্ দিকে?
সুরেন্দ্রবাবুর বজরা যেদিকে যাইতেছিল সেইদিকটা দেখাইয়া দিয়া বলিল, ঐদিকে।
সুরেন্দ্রবাবু একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, আমি ঐদিকেই যাইব। আমার বজরায় স্ত্রীলোক আছে, যদি কোনরূপ আপত্তি না থাকে ত আমার সহিত আইস; তোমাকে বাটী পৌঁছাইয়া দিব।
আবার সে মৌন হইয়া রহিল।
সুরেন্দ্রবাবু না বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, যাইবে?
যাইব।
তবে আইস।
পুনর্বার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সে বলিল, আমার কাপড় ভাসিয়া গিয়াছে।
এইবার সুরেন্দ্রনাথ বুঝিলেন, সে কিজন্য এতক্ষণ ধরিয়া জলে দাঁড়াইয়া আছে। নিজে তীরে নামিয়া মাঝিকে পুনরায় বজরায় ফিরিয়া গিয়া বস্ত্র আনিতে বলিয়া দিয়া বলিলেন, বস্ত্র আসিলে আমার সহিত যাইবে ত?
স্ত্রীলোকটি মাথা নাড়িয়া বলিল, যাইবে।
মাঝি বস্ত্র লইয়া প্রত্যাগমন করিল, অল্পক্ষণ পরে সুরেন্দ্রনাথ সকলকে লইয়া বজরায় আসিয়া উঠিলেন।
বজরায় আসিয়া সুরেন্দ্রবাবু আগন্তুককে জয়াবতীর জিম্মা করিয়া দিলেন; সে মিষ্ট সম্ভাষণ করিয়া, যত্ন, আত্মীয়তা করিয়া তাহাকে আপনার কামরায় সে রাত্রের মত লইয়া গেল।
আহার করাইয়া, পান দিয়া, কাছে বসিয়া জয়াবতী কহিল, ভাই, তোমার নামটি?
আমার নাম মালতী। তোমার নাম?
জয়াবতী। তোমাদের বাড়ি?
মহেশপুরে।
এখান থেকে কত দূরে?
প্রায় দশ-বারো ক্রোশ উত্তরে।
তোমার শ্বশুরবাড়ি কোথা ভাই?
মালতী ঈষৎ হাসিয়া বলিল, কোথাও নয়।
সে কি—বিয়ে হয়নি?
হয়েছিল, কিন্তু সেসব চুকে গেছে।
জয়াবতী একটু দুঃখিতভাবে কহিল, কতদিন?
অনেক দিন। আমার সেসব কথা মনে পড়ে না।
জয়াবতী একথা চাপিয়া দিয়া বলিল, তোমাদের বাড়িতে কে আছে?
কেউ নেই। এক পিসি ছিল, তিনিও বোধ হয় বেঁচে নেই।
জয়াবতী বুঝিল নৌকাডুবির কথা আসিয়া পড়িয়াছে, সুতরাং এ কথারও আন্দোলন করা উচিত মনে করিল না। কহিল, তোমরা কোথায় যাচ্ছিলে ভাই?
মালতী একটু চিন্তা করিয়া বলিল, সাগরদ্বীপে।
যারা তোমার সঙ্গে ছিল তাদের কি হল?
জানিনে।
এখন বাড়ি যাবে?
তাই ভাবচি।
জয়াবতী অল্প হাসিয়া, অল্প অপ্রস্তুতভাবে বলিল, আমার সঙ্গে যাবে?
নিয়ে গেলেই যাই। তোমার স্বামী আমার অনেক উপকার করেছেন। আর বাড়িতেও আমার কেউ নেই! বাড়ি গেলেও যে কার কাছে থাকব তা ত জানিনে।
কথাটা বলিয়া ফেলিয়া জয়াবতী জিভ কাটিয়াছিল; উত্তর শুনিয়া মনে মনে শঙ্কিত হইল। জয়াবতীর মনে হইল—মালতীকে লইয়া যাওয়া বড় সুখের বিষয় হইবে না। সুরেন্দ্রবাবুর নিকট—
মালতী বলিল, তোমাদের বাড়ি কোথায়?
নারায়ণপুরে।
কোথায় যাচ্ছিলে?
বেড়াতে। বাবুর শরীর ভাল নয়, তাই—
আরও দুই-চারিটা কথাবার্তার পর সে রাত্রের মত দুইজনে নিদ্রিত হইয়া পড়িল।
শুভদা – ২.০২
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রাত্রিটা সুরেন্দ্রবাবুর ভাল নিদ্রা হইল না, সেইজন্য অতি প্রত্যুষেই শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিলেন। হাতমুখ ধুইয়া গুড়গুড়ির নল মুখে লইয়া ছাদের উপর আসিয়া বসিলেন। হাওয়ার জোর ছিল, পাল তুলিয়া মাঝিমাল্লারা বজরা খুলিয়া দিল। একটু বেলা হইলে, জয়াবতীকে ডাকিয়া বলিলেন, স্ত্রীলোকটির কিছু জানতে পেরেছ?
সমস্ত।
বাড়ি কোথায়?
মহেশপুরে।
মহেশপুরে কোথায়?
তা জানিনে। এখান থেকে দশ-বারো ক্রোশ উত্তরে।
বাপের নাম কি?
জিজ্ঞাসা করিনি।
সুরেন্দ্রবাবু হাসিয়া বলিলেন, সব খবরই জেনেছ দেখচি! স্বামীর নাম কি?
স্বামী নেই।
শ্বশুরবাড়ি কোথায়?
বলেনি।
সুরেন্দ্রবাবু একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, কি জাত জান কি?
না।
নাম জান?
জানি; মালতী।
মালতীর যদি আপত্তি না থাকে ত একবার আমার কামরায় ডাকতে ব’লো—আমি নিজে সব কথা জিজ্ঞাসা করব।
কিছুক্ষণ পরে একজন ভৃত্য আসিয়া কহিল, কামরায় আসুন।
সুরেন্দ্রবাবুও কালবিলম্ব না করিয়া কামরায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নীচে গালিচার উপর মালতী অধোবদনে বসিয়াছিল। জয়াবতীও নিকটে দাঁড়াইয়াছিল, কিন্তু সুরেন্দ্রবাবু প্রবেশ করিবামাত্র সে প্রস্থান করিল। এ সকল সে জানিত; হয়ত তাহার সম্মুখে সব কথা না হইতে পারে, হয়ত কোন অসুবিধা ঘটিতে পারে, সে তাহা বুঝিত—তাই সরিয়া গেল, কিন্তু অন্তরালে দাঁড়াইয়াছিল কি না, সব কথা শুনিবার বাসনা তাহার ছিল কি না, তাহা বলিতে পারি না।
সুরেন্দ্রবাবু একটা কৌচে আসিয়া উপবেশন করিলেন। নীরবে বহুক্ষণ মালতীর মুখপানে চাহিয়া রহিলেন; মুখখানি বড় ম্লান, বড় বিষণ্ণ,—কিন্তু বড় মনোমুগ্ধকর বোধ হইতেছিল; বর্ণটা বড় সুন্দর, অঙ্গসৌষ্ঠব অতিশয় প্রীতিপ্রদ। তাঁহার বোধ হইল, এতটা রূপ একসঙ্গে তিনি পূর্বে কখন দেখেন নাই। বিধবা—কি জাতি?
সুরেন্দ্রবাবু মুখ ফুটিয়া বলিলেন, তোমার পিতার নাম কি?
মালতী বলিল, শ্রীহারাণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
তিনি বাটীতেই আছেন?
মালতী একটু চিন্তা করিয়া বলিল, না; তিনি নাই।
সুরেন্দ্রবাবু বুঝিলেন তাহার পিতার মৃত্যু হইয়াছে। বলিলেন, বাটীতে আর কে আছে?