আজ একাদশী। ললনা রন্ধনশালায় প্রবেশ করিয়া দেখিল, জননী রন্ধন করিতেছেন। চুলার ভিতর দেখিল কি একটা পদার্থ দগ্ধ হইতেছে। চিনিতে না পারিয়া বলিল, ওটা কি মা? কি পোড়াচ্চ?
চারটি সরষের ফুল।
কি হবে?
ছলনা খাবে। আজ নেয়ে আসবার সময় ক্ষেত থেকে তুলে এনেছিল। ভেজে দিতে বলেছিল; কিন্তু তেল ত নেই, তাই কলাপাত জড়িয়ে পুড়িয়ে দিচ্চি।
ললনা আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না।
আহারের সময় সাধের সরিষার ফুলের আকৃতি-প্রকৃতি দেখিয়া ছলনাময়ী বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, এই বুঝি ভাজা হয়েছে? এ ছাই হয়েছে।
শুভদা ইতস্ততঃ করিয়া ভয়ে ভয়ে বলিল, একটু পুড়ে গেছে।
আমি খেতে চাইনে, তুমি বুঝি পোড়া জিনিস ভালবাস, তাই নিজের মনের মত করে পুড়িয়ে-ঝুড়িয়ে রেখেচ! তা তুমিই খেয়ো—এই রইল। ছলনা মুখখানা তোলো হাঁড়ির মত করিয়া পাতের নীচে নামাইয়া রাখিল।
ছলনা যাহা বলিল তা নিজের বিশ্বাসমত বলিল কি না বলিতে পারি না, কিন্তু আপনার মনোমত কোন দ্রব্য না হইলে কর্কশ কথা বলিতে তাহার মত কেহই পারে না।
অনেক গজগজ করিয়া ছলনা আহার করিয়া চলিয়া যাইলে ললনা বলিল, মা, দিন দিন ছলনা মন্দ হয়ে যাচ্চে; ওকে কিছু বল না কেন? আমার ত ওকে কোন কথা বলতে সাহস হয় না। একটা বললে দশটা শুনিয়ে দেয়।
শুভদা একটু ভাবিয়া বলিল, সব মেয়ে কি তোর মত হয় মা? হাতের পাঁচটা আঙ্গুল পাঁচ রকমের হয়। আমি খাওয়াতে পারিনে, পরাতে পারিনে—কাজেই রাগ করে দুটো কথা বললে সয়ে যেতে হয়।
কিন্তু একি ভাল?
ভাল নয় তা জানি। কিন্তু কি করব? আমার সময় ভাল হলে ছলনাও বলত না, আমাকেও শুনতে হত না।
ললনা বুঝিল জননীর কথা নিতান্ত মিথ্যা নহে।
পরদিন প্রায় এই সময়েই সে অত্যন্ত বিষণ্ণমুখে জননীর নিকট আসিয়া দাঁড়াইল।
শুভদা মুখপানে চাহিয়া বলিল, কি হল?
ললনা একটা টাকা বাহির করিয়া দিয়া বলিল, কৃষ্ণপিসিমা বললেন, আর কাটলেও রক্ত নেই, কুটলেও মাংস নেই। তোমার বাবাকে কিছু উপায় করতে বল, না হলে আমি দুঃখী মানুষ আর টাকাকড়ি কিছুই দিতে পারব না।
সকল কাজকর্ম সেদিনের মত সম্পন্ন হইলে ললনা মাধবের নিকট আসিয়া বসিল।
মাধব বলিল, দিদি, তার কি হল?
কার কি মাধু?
মাধু একটু থামিয়া বলিল, সেখানে যাবার?
ললনাও অল্প থামিল, অল্প চিন্তা করিল, তাহার পর বলিল, সেই কথাই আজ তোকে বলব মাধু।
মাধব আগ্রহে একেবারে উঠিয়া বসিল—কি দিদি? কবে যাওয়া হবে?
আমি কাল যাব।
কাল যাবে? আর আমি?
আমি আগে যাই, তার পরে যেয়ো।
মাধব ব্যস্ততাসহ বলিল, কেন একসঙ্গেই যাই চল না !
ললনা বলিল, না, তা হলে মা বড় কাঁদবেন।
মাধব ক্ষুণ্ণ হইল—কাঁদুক গে।
ছিঃ তা কি হয়? আমি যাই।
আবার কবে আসবে?
তুমি যেদিন যাবে, সেইদিন আর একবার আসব।
তার মধ্যে আর আসবে না?
না।
আমি কবে যাব?
আমি যেদিন নিতে আসব।
আসবে?
হাঁ।
তুমি গেলে মা কাঁদবেন?
বোধ হয়।
মাধব কিছুক্ষণ নিরুত্তর থাকিয়া বলিল, দিদি, তবে কাজ নেই।
কেন ভাই?
মা কাঁদবে মনে হলে আমার ওখানে যেতেই ইচ্ছে হয় না।
তবে তুই যাবিনে?
মাধব আবার কিছুক্ষণ মৌন হইয়া রহিল, তাহার পর বলিল, হ্যাঁ যাব।
তবে আমি কাল যাব?
যেয়ো।
আমাকে না দেখতে পেলে কাঁদবি নে?
কবে আমাকে নিতে আসবে?
আর কিছুদিন পরে।
তবে যাও, আমি কাঁদব না।
মাধবের অলক্ষিতে ললনা দুই-এক ফোঁটা অশ্রু মুছিয়া ফেলিল। সস্নেহে তাহার মাথায় হাত রাখিয়া বলিল, আমি গেলে এসব কথা মাকে বলো না।
না।
মা যখন যা বলবেন, তাই শুনো—কিছুতে যেন মার মনে কষ্ট না হয়। ঠিক সময়ে ওষুধ খেয়ো।
খাব।
কিছুক্ষণ থামিয়া ললনা আবার বলিল, মাধু, সদাদাদাকে তোমার মনে আছে?
আছে।
তিনি যদি আসেন—যদি তোমাকে দেখতে আসেন—
তা হলে?
তা হলে ব’লো যে দিদি চলে গেছে। কেউ যখন না থাকবে তখন ব’লো।
আচ্ছা।
এইসময় শুভদা আসিয়া বলিলেন, অনেক রাত হয়েচে, তুই শুগে যা মা।
মাধব সে কথার উত্তরে বলিল, মা, দিদি আজ আমার কাছে শোবে।
দিদিকে ছাড়িতে মাধবের তখন কিছুতেই ইচ্ছা ছিল না। শুভদা বোধ হয় তাহা বুঝিতে পারিয়া ললনাকে বলিলেন, তবে তাই শোও—আমি ওপরে ছলনার কাছে শুই গে।
শুভদা চলিয়া গেলেও ভ্রাতা-ভগিনীর অনেকক্ষণ ধরিয়া কথাবার্তা চলিল, তাহার পর মাধবচন্দ্র ঘুমাইয়া পড়িল।
পরদিন প্রাতঃকালে ললনাকে কেহ দেখিতে পাইল না। সকালবেলায় সে যেসকল গৃহকর্ম করে তাহা এখন পর্যন্ত পড়িয়া আছে। বেলা আট-নয়টা বাজে দেখিয়া শুভদা মাধবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোর দিদি কোথায়? ছলনাকে বলিলেন, তোর দিদি কোথায় গেল?
সবাই বলিল, বলিতে পারি না।
বেলা অধিক হয় দেখিয়া শুভদা সমস্ত কর্ম নিজেই করিতে লাগিলেন; ছলনাও সেদিন অনেক সাহায্য করিল। আহার্য প্রস্তুত হইল, সকলে আহার করিল—দ্বিপ্রহরও অতীত হইয়া গিয়াছে, তথাপি ললনার দেখা নাই।
রাসমণি খুঁজিতে গেলেন, ছলনাময়ীও আহার করিয়া পাড়া বেড়াইতে গেল, সেখানে যদি ললনা থাকে ত পাঠাইয়া দিবে। সন্ধ্যার পূর্বে রাসমণি আসিয়া বলিলেন, কোথাও ত তাকে পেলাম না—বাড়ি এসেচে কি?
কই না।
সন্ধ্যার পর ছলনাও ফিরিয়া আসিয়া বলিল, দিদি এ গাঁয়ে নেই।
রাত্রি ক্রমশঃ অধিক হইতে লাগিল, কিন্তু ললনা আসিল না।
হারাণবাবু ফিরিয়া আসিয়া অবধি বাটীর বাহির হন নাই; তিনিও, তাই ত মেয়েটা গেল কোথা, বলিয়া একবার খুঁজিতে বাহির হইলেন। রাত্রি বারোটার পর ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, তাই ত, তাই ত—কিছুই যে বোঝা যায় না।