সেই রকমই।
এখন ললনাকে একবার আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিস।
তিনি প্রস্থান করিলে শুভদা ললনাকে ডাকিয়া বলিল, কেষ্টঠাকুরঝি তোকে একবার ডেকে গেছেন, একবার যা।
কেন?
তা জানিনে।
ললনা কৃষ্ণপ্রিয়ার উদ্দেশে প্রস্থান করিল। কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া মাতার হস্তে দুইটি টাকা দিয়া বলিল, পিসিমা দিলেন।
শুভদা মুদ্রা দুইটি অঞ্চলে বাঁধিয়া বলিল, আর কিছু বললেন কি?
হাঁ, বাবা এলে তাঁকে যেন খবর দেওয়া হয়।
শুভদা সেদিন ঠাকুরের উদ্দেশে অনেক প্রণাম করিল, পূজার কক্ষস্থিত কালীপট প্রতি বহুক্ষণাবধি যুক্তকরে চাহিয়া রহিল, তুলসীতলায় অনেক মাথা খুঁড়িল, তাহার পর জিনিসপত্র আনাইতে দিয়া গঙ্গাস্নান করিয়া আসিল।
সেদিন যথাসময়ে মনোমত আহার পাইয়া ছলনাময়ী মনের আনন্দে হাসিতে হাসিতে পুতুলের বিবাহের সম্বন্ধ করিতে ও-পাড়ায় ললিতার নিকট প্রস্থান করিল।
রাত্রে একটু আঁধার হইলে, অন্ধকারে মুখ ঢাকিয়া আজ সমস্ত দিনের পর হারাণচন্দ্র বাটী প্রবেশ করিলেন। ছয় দিবস পূর্বে তিনি যেমন ছিলেন, আজো তেমনি আছেন, কিছুই পরিবর্তন হয় নাই। পরিবর্তন হইয়াছে শুধু বস্ত্রখানার। বর্ণটা অঙ্গার অপেক্ষা কৃষ্ণবর্ণ হইয়াছে এবং গুণিয়া দেখিলে বোধ হয় শতাধিক স্থানে গাঁইট-বাঁধা দেখিতে পাওয়া যাইত। সময়ে যথামত তাঁহাকে আহারাদি করাইয়া শুভদা কন্যা ললনাকে ডাকিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, মা, রোজ যেন তোর মুখ দেখে উঠি—
ললনাও একটু হাসিল—কেন মা?
আজ যে সুখ পেলাম, জন্মেও এমন পাইনি।
পরদিন প্রাতঃকালে ললনা কৃষ্ণপিসিমাকে যাইয়া বলিল, কাল রাতে বাবা এসেছেন।
কৃষ্ণার মুখ প্রফুল্ল হইল; যেন বড় একটা দুর্ভাবনা তিরোহিত হইল। স্মিতমুখে বলিলেন, এসেচে? ভাল আছে?
হাঁ।
এতদিন কোথায় ছিল?
তা জানিনে।
বৌ জিজ্ঞাসা করেনি?
না।
তোর পিসিমা কিছু বলেনি?
না। তিনি ত বাবার সঙ্গে কথা কন না।
কথা কন না? কেন?
তা জানিনে। পিসিমাই জানেন।
বেলা এগারটার সময় কৃষ্ণপ্রিয়া কলাপাতা-চাপা একটা পাথরের বাটি হাতে করিয়া শুভদার নিকট আসিয়া বলিল, বৌ, একটু তরকারি এনেচি, হারাণকে দিস।
শুভদা বাটিটি হাতে লইয়া পার্শ্ববর্তী একটা ঘর উদ্দেশ করিয়া বলিল, ঐ ঘরে আছেন।
কৃষ্ণপ্রিয়া বুঝিতে পারিয়া বলিল, তা হোক, এখন আর যাব না, ঘরে সমস্ত জিনিস আদুড় পড়ে আছে।
কৃষ্ণপ্রিয়া চলিয়া যাইতেছিলেন, কিন্তু অর্ধ উঠান হইতে ফিরিয়া আসিয়া শুভদাকে বলিলেন, বৌ, হারাণকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারবি?
কি?
এতদিন সে কোথায় ছিল?
শুভদা মাথা নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা।
খাওয়াইতে বসাইয়া শুভদা ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, এতদিন কোথায় ছিলে?
হারাণচন্দ্র মলিনমুখে অধোবদন হইয়া বলিলেন, গাছতলায়।
শুভদা আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না।
পরদিন দুপুরবেলা কৃষ্ণপ্রিয়া আবার আসিলেন। নানা কথাবার্তার পর বলিলেন, বৌ, সেকথা জিজ্ঞাসা করেছিলি?
হাঁ।
কি বললে?
বললেন যে, গাছতলায় ছিলাম।
আবার অন্যান্য কথাবার্তা চলিতে লাগিল। উঠিবার সময় কৃষ্ণপ্রিয়া কাপড়ের নীচ হইতে দু’খানা থান কাপড় বাহির করিয়া বলিলেন, ঘরে ছিল তাই নিয়ে এলাম। হারাণকে পরতে দিস।
শুভদা তাহা হাত পাতিয়া গ্রহণ করিল।
কৃষ্ণপ্রিয়া কিছুক্ষণ তাহার মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া ঈষৎ মৃদুস্বরে বলিলেন, দেখ বৌ, হারাণ যদি জিজ্ঞাসা করে, কে দিয়েচে, তা হলে আর কারো নাম করিস। আমার নাম করিস নে।
শুভদা ঈষৎ হাসিয়া বলিল, কেন?
কৃষ্ণপ্রিয়া ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, না অমনি।
আর যদি নাম করি?
এবার কৃষ্ণপ্রিয়াও সহাস্যে বলিলেন, তা হলে তোর কেষ্টঠাকুরঝির মাথা খাবি।
আবার একদিন–দুইদিন করিয়া দিন কাটিতে লাগিল। হারাণচন্দ্র এবার আসিয়া অবধি আর বাটীর বাহির হন না। শুভদার সে পক্ষে কিছু ভয় দূর হইয়াছে; কিছু দুর্ভাবনা দূর হইয়াছে, কিন্তু সংসার চলে কিরূপে? দুর্ভাবনার মূল হইয়াছে এইখানেই। কে একদিন একটাকা দান করিল, কে আর–একদিন দুই টাকা ভিক্ষা দিল, এমন করিয়া কি একটা পরিবার প্রতিপালিত হয়? ভাবনার কথা কি শুধু ইহাই? মাধবের মুখ দেখিলে ত শরীরের অর্ধেক রক্ত জল হইয়া যায়; তাহার উপর ছলনা। সে দিন দিন বাড়িয়া উঠিতেছে; বিবাহের বয়স হইয়াছে, এমন কি দুই–চারি মাসের মধ্যে হয়ত সে–বয়স উত্তীর্ণ হইয়াও যাইতে পারে। এদিকে চাহিলে শুভদা আর কূলকিনারা দেখিতে পায় না। মাধবের নিকট পার আছে, কিন্তু বাঙ্গালীর ঘরে ছলনার নিকট পার নাই। তাহার মুখ দেখিলে রক্ত জল হইয়া যায়, কিন্তু ইহার মুখ দেখিলে শরীরের অস্থিপঞ্জর পর্যন্ত তরল হইয়া পড়িবার উপক্রম করে। দুর্ভাবনায় দুর্ভাবনায় শুভদা যে প্রতিদিন শুকাইয়া যাইতেছে, তাহা আর কেহ না দেখিতে পাইলেও ললনা দেখিতে পাইত। গঙ্গার ঘাট হইতে এক কলসী জল আনিতে জননী যে হাঁপাইতে থাকেন, ললনা তাহা দেখিতে পাইত; তরকারি কুটিবার সময় আলু–পটলের খোসা ছাড়াইতে গিয়া হাত আটকাইয়া বাধিয়া যায়, ললনা তাহা জানিতে পারিত; গ্রামে শুভদার মত কেহ সুপারি কাটিতে পারিত না, সেই শুভদার সুপারি কাটা আজকাল সরু–মোটা হইয়া যায়,
ললনা তাহা বুঝিতে পারিত; আহার কমিয়া গিয়াছে, দুইবেলার পরিবর্তে আজকাল বেলা চারিটার সময় একবার দাঁড়াইয়াছে; পীড়াপীড়ি করিলে বলে আদতে ক্ষুধা নাই। ললনা এসব দেখিত আর লুকাইয়া চক্ষু মুছিত; কখন কখন ঘরে দ্বার দিয়া মাথা কুটিত। ইহাতে ফল হইবার হইলে হইতে পারিত, কিন্তু জগতে তাহা হয় না।
শুভদা – ১.১৩
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ