ললনা মুখ তুলিয়া বলিল, আমার প্রয়োজন আছে।
কি প্রয়োজন?
বলিতেছি।
পুনরায় বহুক্ষণ নিস্তব্ধে অতিবাহিত হইলে শারদাচরণ বলিল, কই বলিলে না?
বলিতেছি। পূর্বে তুমি আমাকে ভালবাসিতে, এখন আর বাস কি?
প্রশ্নের ভাবে শারদাচরণ বড় বিস্মিত হইল। কহিল, সে কথা কেন?
কাজ আছে।
যদি বলি এখনও ভালবাসি?
ললনা মৃদু হাসিয়া সলজ্জে বলিল, আমাকে বিবাহ করিবে?
শারদাচরণ একটু পিছাইয়া বসিল। বলিল, না।
কেন করিবে না?
তোমাকে বিবাহ করিলে জাতি যাইবে।
গেলেই বা।
খাইব কি?
খাইবার ভাবনা তোমাকে করিতে হইবে না।
কিন্তু পিতার মত হইবে না।
হইবে। তুমি তাঁহার ত একটিমাত্র সন্তান; ইচ্ছা করিলে মত করিয়া লইতে পারিবে।
কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া শারদাচরণ বলিল, তবুও হয় না।
কেন?
অনেক কারণ আছে। প্রথমতঃ পিতার মত হইলেও, তোমাকে বিবাহ করিলেই জাতি যাইবে। জাতি খুইয়ে হলুদপুর তিষ্ঠান আমাদিগের সুখের হইবে না। আর আমার এমন অর্থও নাই যে, তোমাকে লইয়া বিদেশে গিয়া থাকিতে পারি। দ্বিতীয়তঃ যাহা ফুরাইয়া গিয়াছে তাহা ফুরাইয়াই যাউক, ইহা আমার ইচ্ছাও বটে, মঙ্গলের কারণও বটে।
ললনা কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া কহিল, তবে তাহাই হউক। কিন্তু আমার একটি উপকার করিবে?
বল, সাধ্য থাকে ত করিব।
তোমার সাধ্য আছে, কিন্তু করিবে কিনা বলিতে পারি না।
বল; সাধ্যমত চেষ্টা করিয়া দেখিব।
আমার ভগিনী ছলনাকে বিবাহ কর।
শারদাচরণ ঈষৎ হাসিয়া বলিল, কেন, তাহার কি পাত্র জুটিতেছে না?
কৈ জুটিতেছে? আমরা দরিদ্র; দরিদ্রের ঘরে কে সহজে বিবাহ করিবে? শুধু তাই নয়। আমরা কুলীন; অঘরে বিবাহ দিলে হয়ত বর জুটিতে পারে, কিন্তু তাহা হইলে কুলে জলাঞ্জলি দিতে হয়। তোমরা আমাদের পালটি ঘর; তুমি বিবাহ করিলে সবদিকই রক্ষা হয়। বিবাহ করিবে?
আমি পিতার সম্পূর্ণ আজ্ঞাধীন। তাঁর মত না লইয়া কোন কথাই বলিতে পারিব না।
তবে মত লইয়া বিবাহ কর।
আমি যতদূর জানি, এ বিবাহে তাঁহার মত হইবে না।
ললনা ম্লানভাবে কহিল, কেন মত হইবে না?
তবে তোমাকে বুঝাইয়া বলি। লুকাইয়া কোন ফল নাই। আমার পিতা কিছু অর্থপিপাসু; তাঁহার ইচ্ছা যে আমার বিবাহ দিয়া কিছু অর্থ লাভ করেন। তোমরা অবশ্য কিছুই দিতে পারিবে না, তখন বিবাহও হইবে না।
ললনা কাতর হইয়া বলিল, আমরা দরিদ্র, কোথায় কি পাইব? আর তোমাদের অর্থের প্রয়োজন কি? যথেষ্ট ত আছে।
শারদাচরণ দুঃখিতভাবে মৃদু হাসিয়া বলিল, সেকথা আমি বুঝি, কিন্তু তিনি বুঝিবেন না।
তুমি বুঝাইয়া বলিলে নিশ্চয় বুঝিবেন।
আমি একবার মাত্র বলিব; বুঝাইয়া বলিতে পারিব না।
ললনা নিতান্ত বিষণ্ণ হইয়া বলিল, তবে কেমন করিয়া হইবে?
আমি কি করিব?
তোমার বোধ হয় বিবাহ করিতে ইচ্ছা নাই।
না।
ছলনার মত কন্যা তুমি সহজে পাইবে না। সে সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, কর্মিষ্ঠা—অধিকন্তু একজন দরিদ্রের যথেষ্ট উপকার করা হইবে, একজন ব্রাহ্মণের জাতি-কুল রক্ষা করা হইবে এবং আমি চিরদিন তোমার কেনা হইয়া থাকিব। বল, এ বিবাহ তুমি করিবে?
পিতা যাহা বলিবেন তাহাই করিব।
আজ তোমাকে সকল কথা বলি। হয়ত এজন্মে আর কখন বলিবার অবসর পাইব না, তাহাই বলি—তোমাকে লজ্জা কখন করি নাই, আজও করিব না। সমস্ত কথা খুলিয়া বলিয়া যাই—তোমাকে চিরদিন ভালবাসিয়া আসিয়াছি, এখনো ভালবাসি। একথা পূর্বে একবার বলিয়াছিলাম, আজ বহুদিন পরে আর একবার শেষ বলিলাম। তুমি, আমার একমাত্র অনুরোধ—বোধ হয় এই শেষ অনুরোধ—রাখিলে না। যা হইবার হইল, আর এমন কখন হইবে না। মিথ্যা তোমাকে এত ক্লেশ দিলাম, সেজন্য ক্ষমা করিও।
শারদাচরণ মনে মনে ক্লেশ অনুভব করিল। ললনা চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া বলিল, পিতাকে এবিষয়ে অনুরোধ করিব।
ললনা না ফিরিয়াই বলিল, করিও।
কিন্তু আমি পিতার আজ্ঞাধীন।
ললনা চলিতে চলিতে বলিল, তাহা ত শুনিলাম।
যদি কিছু করিতে পারি তোমাকে জানাইব।
ভাল।
ললনা, আমাকে ক্ষমা করিও।
করিয়াছি।
শুভদা – ১.১০
দশম পরিচ্ছেদ
আমার নক্সা,—দাও বাবা চার আনা পয়সা। ‘গাড্ডিলে’র হাত হইতে চারি আনা তাম্রখণ্ড গুণিয়া লইয়া হারাণচন্দ্র কোঁচার খুঁটে জড়াইয়া রাখিলেন। যা থাকে কপালে—ধরলাম আট আনা। আট আনা পয়সা হারাণচন্দ্র সম্মুখে শতচ্ছিন্ন চাটায়ের উপর ঠুকিয়া রাখিয়া তাস হাতে লইলেন। সঙ্গীরা সকলেই উৎকণ্ঠিতভাবে স্ব স্ব তাস দেখিতে লাগিল। অল্পক্ষণ পরেই হাত দুই-তিন লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন, ফের নক্সা—দাও ত চাঁদ টাকা! ‘গাড্ডিল’ হারাণচন্দ্রকে টাকা দিয়া তাহার সম্মুখে তাস জোড়া নিক্ষেপ করিল। অপরাপর সকলে একটু শুষ্ক হাস্য করিয়া স্ব স্ব তহবিল হাতড়াইয়া পয়সা বাহির করিতে লাগিল।
আর চাই—আর চাই—আর চাই?
বস্ কর—আর না।
পনরতে চেপে যাও।
পচে যা—পচে যা বাবা—এই আমার নক্সা।
প্রায় নিশাবসানে হারাণচন্দ্র যখন স্থান পরিত্যাগ করিলেন তখন কোঁচার টিপ টাকায় পয়সায় রীতিমত ভারী। সে রাত্রে তাঁহার আর বাটী যাওয়া হইল না। পরদিনও এ দোকান সে দোকান করিয়া বেলা দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গেল। বেলা চারিটার সময় যখন তিনি বাটিতে প্রবেশ করিলেন তখন তাঁহার চক্ষু অসম্ভব রক্তবর্ণ; মুখ, নাক, কাপড়, চাদর, সর্বাঙ্গ হইতে গঞ্জিকার দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে।
হারাণচন্দ্র স্নান করিয়া আহার করিতে বসিলে শুভদা সম্মুখে উপবেশন করিয়া বলিল, আজ বড় বেলা হয়েচে।
কি করি বল, কাজের গতিকে বেলা হয়ে যায়। তুমি এখনো কি খাওনি?