কি দেব?
যা হয় দাও।
বড়দিদি কাছে বসিয়া থাকিলে ত আর কথাই নাই। দুজনে চুপি চুপি অনেক কথা কহে, বিস্তর পরামর্শ করে; কিন্তু কেহ আসিয়া পড়িলে চুপ করিয়া যায়।
এখন হইতে হারাণের সংসারে আর তেমন ক্লেশ নাই। যখন বড় কিছু হয় তখনই ললনা দুটো – একটা টাকা বাহির করিয়া দেয়। শুভদা জানে, কোথা হইতে টাকা আসিতেছে, রাসমণি ভাবে হারাণ কোথা হইতে লইয়া আসে, হারাণ ভাবে, মন্দ কি! যখন কোথা হইতে আসিতেছে, তখন কোথা হইতেই আসুক। আমিই বা কোথা হইতে আনিব? তবে একটা কথা তাঁহার আজকাল প্রায়ই মনে হইতেছে, সে কথাটা আফিমের মৌতাত সম্বন্ধে। মাঝে মাঝে ভয় হয়, অভ্যাসটা বুঝি একেবারেই ছাড়িয়া যাইতেছে। আর ছাড়িলেই বা উপায় কি? বাহাল রাখিবার মত আফিম বা কোথা হইতে যোগাইব? যেমন করিয়াই হউক আর যাহা করিয়াই হউক পেট ভরিয়া যখন চারিটা খাইতে পাইতেছি, তখন ওজন্য আর মন খারাপ করিব না; সময় ভাল হইলে আবার সবই হইবে, এখন যেমন আছি তেমনিই থাকি।
দিনকতক পরে সদানন্দর পিসিমাতা একদিন তাহাকে ধরিয়া বসিলেন, বাবা, আমাকে একবার কাশী করিয়া লইয়া আইস; কবে মরিব কিছুই জানা নাই, অন্ততঃ এজন্মে একবার কাশী বিশ্বেশ্বর দেখিয়া লই।
সদানন্দ কোন কিছুতেই আপত্তি করে না, ইহাতেও করিল না। দুই–একদিন পরে কাশী যাইবে স্থির করিল। যাইবার দিন সন্ধ্যাবেলা ‘ললনা’, ললনা’ ডাকিতে ডাকিতে সে একেবারে উপরে আসিয়া উঠিল। ললনা তখন উপরেই ছিল, সদানন্দকে আসিতে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সদানন্দ কোঁচার কাপড়ে করিয়া গোটা–পঞ্চাশ টাকা বাঁধিয়া আনিয়াছিল, সেইগুলি খুলিয়া একটা বালিশের তলায় চাপা দিয়া রাখিয়া বলিল, আমরা আজ কাশী যাইব। কবে ফিরিব বলিতে পারি না। যদি প্রয়োজন হয় এগুলি খরচ করিও।
ললনা বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিল—এত টাকা?
সঙ্গে সঙ্গে সদানন্দও হাসিয়া উঠিল—কত টাকা? পঞ্চাশ টাকা বেশি টাকা নহে! দেখিতে অনেকগুলি বটে, কিন্তু খরচের সময় খরচ করিতে অনেক নহে।
কিন্তু এত—
কথা শেষ করিতে না দিয়াই সদানন্দ কি একরূপ হস্তভঙ্গি করিয়া একেবারে নীচে আসিয়া রন্ধনশালায় শুভদার নিকট আসিয়া বসিল।
খুড়িমা, আজ আমরা কাশী যাব।
শুভদা সে কথা শুনিয়াছিলেন। বলিলেন, কবে আসবে?
তা কেমন করে বলব? তবে পিসিমার কাশী দেখা হলেই ফিরে আসব বোধ হয়। শুভদা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তাই এস বাবা। আশীর্বাদ করি নিরাপদে থেক।
সদানন্দ উচ্চ হাসিয়া প্রস্থান করিল। পরদিন ললনা অর্ধেকগুলি টাকা নিজের নিকট রাখিয়া অপর অর্ধেক মাতৃসকাশে ধরিয়া দিয়া বলিল, মা, যাবার সময় সদাদাদা এই টাকাগুলি দিয়ে গেছেন।
শুভদা চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া সেগুলি গুণিতে লাগিলেন। গণনা শেষ করিয়া কন্যার পানে চাহিয়া বলিলেন, সদানন্দ আর–জন্মে বোধ হয় আমাদের কেউ ছিল।
ললনা মাথা নাড়িয়া বলিল, বোধ হয়।
এত টাকা কি মানুষে দিতে পারে?
ললনা উত্তর দিল না।
ললনা, সদানন্দ কি পাগল?
কেন?
তবে এমন করে কেন?
দুঃখীর দুঃখে দুঃখী হওয়া কি পাগলের কাজ?
তবে লোকে পাগল বলে কেন?
ললনা সহাস্যে বলিল, লোকে অমন বলে থাকে।
হারাণ মুখুজ্যের সংসারে আজকাল কষ্ট নাই বলিলেই হয়। খাওয়া–পরা বেশ চলিয়া যাইতেছে, কিন্তু পাড়ার পাঁচজনে পাঁচ কথা বলিতে লাগিল।
কেহ বলিল, হারাণে বেটা নন্দীদের ঢের টাকা মারিয়াছে; কেহ বলিল, বেটা আজকাল একটা বড়লোক। কেহ বলিল, কিছুই নাই—বাড়িতে দুবেলা হাঁড়ি চড়ে না। এমনি অনেক কথা হইত। যাহারা পর তাহারা একটু কম কৌতূহলী হইয়া রহিল, যাহারা একটু আত্মীয় তাহারা অধিক কৌতূহলী হইয়া মুখোপাধ্যায়–পরিবার সম্বন্ধে অল্পবিস্তর ছিদ্র খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
একদিন দুপুরবেলা কৃষ্ণঠাকুরানী সহসা আবির্ভূত হইয়া বলিলেন, বলি বৌয়ের কি হচ্ছে? খাওয়া–দাওয়া চুকল কি?
শুভদা বলিল, হাঁ, এইমাত্র।
তখন কৃষ্ণঠাকুরানী পানের সহিত তামাকপত্র চর্বণ করিতে করিতে এবং পিক্ ফেলিতে ফেলিতে উপযুক্ত স্থানে উপবেশন করতঃ বলিলেন, বৌ, হারাণ আজকাল করছে কি?
কি আর করবেন—চাকরি–বাকরির চেষ্টা করছেন।
সংসার চলচে কেমন করে?
শুভদা উত্তর করিল না।
কৃষ্ণঠাকুরানী আবার বলিলেন, লোকে বলে হারাণ মুখুজ্যে নন্দীদের ঢের টাকা মেরেচে; সে আজকাল বড়লোক—তার খাবার ভাবনা কি? কিন্তু আমি ত সব কথা জানি, তাই বলি, সংসার এখন চলে কেমন করে?
শুভদা ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, অমনি একরকম করে।
হারামজাদা মাগী বামুনপাড়ার কাতি, সে–ই ত দুর্ঘটনা ঘটালে। ইচ্ছে করে মুখপুড়ীকে পাঁশ পেড়ে কাটি।
শুভদা একথা কানে না তুলিয়া বলিল, ঠাকুরঝি, তোমার খাওয়া হয়েছে?
হাঁ বোন, হয়েছে। সেই হারামজাদীই ত এই সর্বনাশ ঘটালে। হারাণ মুখ্যু কি না, তাই তার ফাঁদে পা দিলে। তিন হাজার টাকা চুরি করলি, না হয় দু শ’ এক শ’ মাগীর হাতেই এনে দিতিস! তবু ত কিছু থাকত?
শুভদা বলিল, ঠাকুরঝি, আজ কি রাঁধলে?
কি আর রাঁধব বোন? আজ বেলা হয়ে গিয়েছিল, তাই ভাতে–ভাত ছাড়া আর কিছুই করিনি। তা মাগীর কি ছাই একটু পরকালের ভাবনাও আছে? মিন্সে দুটো টাকার জন্যে যখন হাতে–পায়ে ধরলে, তখন কিনা ঘর থেকে বের করে দিলে! কিন্তু ভগবান কি নেই? বামুনের যেমন সর্বনাশ করেছে, তোর মতন সতীলক্ষ্মীর যখন চোখের জল ফেলিয়েচে, তখন শাস্তি কি হবে না? তুই দেখিস, আমি বললাম—