ব্রজরাজবাবু ফিরিয়া আসিয়া সব কথা শুনিয়া মাধবীকে কহিলেন, কাজটা ভাল হয়নি মা। মাধবী কষ্টে অশ্রু সংবরণ করিল।
এদিকে সুরেন্দ্রনাথ পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইত। তিনদিন অনাহারে কাটিল, কলের জলে পয়সা লাগে না, তাই ক্ষুধা পাইলে পেট ভরিয়া জল খাইত।
একদিন রাত্রে অবসন্ন শরীরে সে কালীঘাটে যাইতেছিল, কোথায় নাকি শুনিয়াছিল, সেখানে খাইতে পাওয়া যায়। অন্ধকার রাত্রি, তাহাতে আবার মেঘ করিয়াছিল, চৌরঙ্গীর মোড়ে একখানা গাড়ি তাহার উপর আসিয়া পড়িল। গাড়োয়ান কোনরূপে অশ্বের বেগ সংবরণ করিতে পারিয়াছিল। সুরেন্দ্র প্রাণে মরিল না বটে কিন্তু বক্ষে ও পার্শ্বে প্রচন্ড আঘাত পাইয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেল। পুলিশ আসিয়া গাড়ি করিয়া হাসপাতালে লইয়া গেল। চার-পাঁচদিন অজ্ঞান অবস্থায় অতীত হইবার পর, রাত্রে চক্ষু চাহিয়া কহিল, বড়দিদি!
কলেজের একজন ছাত্র, যে সে-রাত্রে
ডিউটিতে ছিল, শুনিতে পাইয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। সুরেন্দ্র কহিল, বড়দিদি এসেছেন?
কাল সকালে আসবেন।
পরদিন সুরেন্দ্রের বেশ জ্ঞান হইল, কিন্তু বড়দিদির কথা কহিল না, প্রবল জ্বরে সমস্তদিন ছটফট করিয়া সন্ধ্যার সময় একজনকে জিজ্ঞাসা করিল, আমি হাসপাতালে আছি?
হ্যাঁ।
কেন?
আপনি গাড়িচাপা পড়েছিলেন।
বাঁচার আশা আছে?
নিশ্চয়।
পরদিন সেই ছাত্রটি কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার আত্মীয় কেহ এখানে আছেন?
কেহ না।
তবে সে-রাত্রে বড়দিদি বলে ডাকছিলেন কাকে? তিনি কি এখানে আছেন?
আছেন, কিন্তু তিনি আসতে পারবেন না। আমার পিতাকে সংবাদ দিতে পারেন?
পারি।
সুরেন্দ্রনাথ পিতার ঠিকানা বলিয়া দিল। সেই ছাত্রটি সেদিন পত্র লিখিয়া দিল। তাহার পর বড়দিদির সন্ধান লইবার জন্য জিজ্ঞাসা করিল,―এখানে স্ত্রীলোক ইচ্ছা করিলে আসতে পারেন, আমরা সে বন্দোবস্ত করতে পারি। আপনার জ্যেষ্ঠা ভগিনীর ঠিকানা জানতে পারলে তাঁকেও সংবাদ দিতে পারি।
সুরেন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া ব্রজরাজবাবুর ঠিকানা কহিয়া দিল।
আমার বাসা ব্রজরাজবাবুর বাড়ির নিকটেই, আজ তাঁকে আপনার অবস্থা জানাব। যদি ইচ্ছা করেন, তিনি দেখতে আসতে পারেন।
সুরেন্দ্র কথা কহিল না। মনে মনে বুঝিল–বড়দিদির আসা অসম্ভব। ছাত্রটি কিন্তু দয়াপরবশ হইয়া ব্রজবাবুকে সংবাদ দিল। ব্রজবাবু চমকিত হইলেন–বাঁচবে ত?
সম্পূর্ণ আশা আছে।
বাড়ির ভিতর গিয়া কন্যাকে কহিলেন, মাধবী, যা ভাবছিলাম তাই হয়েছে। সুরেন গাড়িচাপা পড়ে হাসপাতালে আছে।
মাধবীর সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিহরিয়া উঠিল।
তোমার নাম করে নাকি বড়দিদি বলে ডাকছিল। তুমি দেখতে যাবে? এই সময় পার্শ্বের কক্ষে প্রমীলা ঝনঝন করিয়া কি-সব ফেলিয়া দিল। মাধবী সেইদিকে ছুটিয়া গেল। অনেকক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, তুমি দেখে এসো, আমি যেতে পারব না।
ব্রজবাবু দুঃখিতভাবে ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, সে বনের পশু, তার উপরে কি রাগ করে?
মাধবী কথা কহিল না। তবে ব্রজবাবু একাকী সুরেন্দ্রকে দেখিতে আসিলেন। দেখিয়া বড় দুঃখ হইল, কহিলেন, সুরেন, তোমার পিতামাতাকে সংবাদ দিলে হয় না?
সংবাদ দিয়েছি।
কোন ভয় নেই, তাঁরা আসলেই একটা বন্দোবস্ত করে দেব।
ব্রজবাবু টাকাকড়ির জন্য চিন্তা করিয়া কহিলেন, বরং আমাকে তাঁদের ঠিকানা বলে দাও, যাতে তাঁদের এখানে আসার পক্ষে কোনরূপ অসুবিধা না হয়, তা করে দেব।
সুরেন্দ্র কথাটা তেমন বুঝিল না। বলিল, বাবা আসবেন, অসুবিধা আর কি আছে?
ব্রজবাবু বাড়ি ফিরিয়া মাধবীকে সমস্ত সংবাদ জ্ঞাত করাইলেন।
সেই অবধি নিত্য তিনি একবার করিয়া সুরেন্দ্রকে দেখিতে যাইতেন। তাহার উপর একটা স্নেহ জন্মিয়াছিল। একদিন ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, মাধবী, তুমি ঠিক বুঝেছিলে, সুরেনের পিতা বেশ অর্থবান লোক।
মাধবী সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, কেমন করে জানলে?
তার পিতা একজন বড় উকিল; কাল রাত্রে তিনি এসেছেন।
মাধবী মৌন হইয়া রহিল। তাহার পিতা কহিলেন, সুরেন বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল।
কেন?
ব্রজরাজবাবু কহিলেন, তাহার পিতার সহিত আজ আলাপ হইল। তিনি সেকথা সমস্ত বলিলেন। এই বৎসর পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ সম্মানের সহিত সুরেন এম. এ.পাশ করিলে বিলাত যাইতে চাহিয়াছিল, কিন্তু নিতান্ত অন্যমনস্ক প্রকৃতির লোক বলিয়া তাঁহার পিতা সাহস করিয়া পাঠাইতে চাহেন নাই; তাই রাগ করিয়া পলাইয়া আসিয়াছিল। সে ভাল হইলে তিনি বাটী লইয়া যাইবেন।
নিঃশ্বাস রুদ্ধ করিয়া, উচ্ছ্বসিত অশ্রু সংবরণ করিয়া লইয়া মাধবী বলিল, তাই ভাল।
বড়দিদি – ০৬
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ছয় মাস হইল সুরেন্দ্রনাথ চলিয়া গিয়াছে। ইহার মধ্যে মাধবী একটিবার মাত্র মনোরমাকে পত্র লিখিয়াছিল , আর লেখে নাই ।
পূজার সময় মনোরমা পিতৃভবনে আসিয়া মাধবীকে ধরিয়া বসিল, তোর বাঁদর দেখা।
মাধবী হাসিয়া কহিল , বাঁদর কোথায় পাব লো?
মনোরমা তাহার চিবুকে হাত দিয়া সুর করিয়া মৃদুকন্ঠে গাহিল–
আমি এলাম ছুটে দেখব বলে,
কেমন শোভে পোড়ার বাঁদর–
তোমার ঐ রাঙ্গা চরণতলে।
সেই যে পুষেছিলি?
কবে?
মনোরমা মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল, মনে নেই! যে তোকে বৈ আর জানত না?
মাধবী কথাটা অনেকক্ষণ বুঝিয়াছিল, তাই অল্পে অল্পে মুখখানি বিবর্ণ হইতেছিল; তথাপি আত্মসংবরণ করিয়া কহিল, ও– তাঁর কথা? তিনি আপনি চলে গেছেন।
অমন রাঙ্গা পা-দুটি তার পছন্দ হল না?