ইহার তিনদিন বাদে যখন জমিদারের পিয়াদা তাহার দ্বারপথে আসন করিয়া বসিল এবং হাঁক-ডাক করিয়া গ্রামবাসীকে জানাইতে লাগিল যে, সুরেন রায় আর একটা নূতন কীর্তি করিয়াছে, তখন মাধবী সন্তোষের হাত ধরিয়া দাসীকে অগ্রবর্তিনী করিয়া নৌকায় উঠিয়া বসিল।
বাটীর অদূরেই নদী; মাঝিকে কহিয়া দিল, সোমরাপুরে যাইতে হইবে। একবার প্রমীলাকে দেখিয়া যাইতে হইবে।
গোলাগাঁ হইতে পনর ক্রোশ দূরে সোমরাপুরে প্রমীলার বিবাহ হইয়াছিল। আজি এক বৎসর হইতে সে শ্বশুরঘর করিতেছে। সে হয়ত আবার কলিকাতায় যাইবে, কিন্তু মাধবী তখন কোথায় থাকিবে? তাই একবার দেখা করা।
সকালবেলা সূর্যোদয়ের সঙ্গে মাঝিরা নৌকা খুলিয়া দিল। স্রোতের মুখে নৌকা ভাসিয়া চলিল; বাতাস অনুকূল ছিল না, তাই ধীরমন্থর গমনে ক্ষুদ্র নৌকা বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়া,শিয়াকুল ও বেতঝোপের কাঁটা বাঁচাইয়া,শরঝাড় ঠেলিয়া ধীরে ধীরে চলিল। সন্তোষকুমারের আনন্দ ধরে না! সে ছইয়ের ভিতর হইতে হাত বাড়াইয়া গাছের পাতা ও ডগা ছিঁড়িবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল। মাঝিরা কহিল, বাতাস না থামিলে, কাল দুপুর পর্যন্ত নৌকা সোমরাপুরে লাগিবে না।
আজ মাধবীর একাদশী, কিন্তু সন্তোষকুমারের জন্য কোথাও পানসি বাঁধিয়া,
পাক করিয়া তাহাকে খাওয়াইতে হইবে। মাঝি কহিল, দিস্তেপাড়ার গঞ্জে নৌকা বাঁধিলে বেশ সুবিধা হইবে, সেখানে সব জিনিস পাওয়া যায়।
দাসী কহিল, তাই কর বাপু, যেন দশটা-এগারটার মধ্যে ছেলেটা খেতে পায়।
বড়দিদি – ০৯
নবম পরিচ্ছেদ
কার্তিক মাস যায় যায়। একটু শীত পড়িয়াছে। সুরেন্দ্রনাথের উপরের ঘরে জানালার ভিতর দিয়া প্রাতঃসূর্যালোক প্রবেশ করায় বড় মধুর বোধ হইতেছে। জানালার কাছে অনেকগুলি বাঁধা-খাতা ও কাগজপত্র লইয়া টেবিলের এক পাশে সুরেন্দ্রনাথ বসিয়াছিলেন; আদায়-উসুল, বাকি-বকেয়া, জমা-খরচ, বন্দোবস্ত, মামলা-মকদ্দমার নথিপত্র সব একে একে উল্টাইয়া দেখিতেছিলেন। এসব দেখাশুনা একরকম আবশ্যকও হইয়া পড়িয়াছিল এবং না হইলে সময়ও কাটে না। শান্তির সহিত এ জন্য অনেকখানি ঝগড়া করিতে হইয়াছিল। অনেক করিয়া তবে তাহাকে সে বুঝাইতে পারিয়াছিল যে, অক্ষরের পানে চাহিলেই মানুষের বুকের ব্যথা বাড়িয়া যায় না, কিংবা তৎক্ষণাৎ ধরাধরি করিয়া তাহাকে বাহিরে লইয়া যাইবার প্রয়োজন হয় না। অগত্যা শান্তি স্বীকার করিয়াছে এবং আবশ্যকমত সাহায্যও করিতেছে।
আজকাল স্বামীর উপর তাহার পুরা অধিকার–তাহার একটি কথাও অমান্য হয় না। কোন দিনই হয় নাই, শুধু পাঁচজন হতভাগা ইয়ার-বন্ধু মিলিয়া দিন-কতক শান্তিকে বড় দুঃখ দিতেছিল। স্ত্রীর আদেশে সুরেন্দ্রের বাহির-বাটীতে পর্যন্ত যাওয়া নিষিদ্ধ হইয়াছে। ডাক্তার মহাশয়ের পরামর্শ ও উপদেশ শান্তি প্রাণপণে খাটাইয়া তুলিবার আয়োজন করিয়াছে।
এইমাত্র সে কাছে বসিয়া রাঙ্গা ফিতা দিয়া কাগজের বান্ডিল বাঁধিতেছিল। সুরেন্দ্রনাথ একখানা কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া সহসা ডাকিলেন, শান্তি!
শান্তি কোথায় গিয়াছিল–কিছুক্ষণে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ডাকছিলে?
হাঁ, আমি একবার কাছারিঘরে যাব।
না। কি চাই বল, আমি আনিয়ে দিচ্চি।
কিছু চাই না, একবার মথুরবাবুর সঙ্গে দেখা করব।
তাঁকে ডাকিয়ে পাঠাই, তোমাকে যেতে হবে না। কিন্তু, এমন সময় তাঁকে কেন?
বলে দেব যে অগ্রহায়ণ মাস থেকে তাঁকে আর কাজ করতে হবে
না।
শান্তি বিস্মিত হইল; কিন্তু সন্তুষ্ট হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তাঁর অপরাধ?
অপরাধ যে কি, তা এখন ঠিক বলতে পার্চি না, কিন্তু বড় বাড়াবাড়ি কর্চেন। তাহার পর আদালতের সার্টিফিকেট ও কয়েকখানা কাগজপত্র দেখাইয়া কহিলেন, এই দেখ, গোলাগাঁয়ে একজন বিধবার ঘর-বাড়ি সমস্ত বেনামী নিলামে খরিদ করে নিয়েচে। আমাকে একবার জিজ্ঞাসাও করেনি।
শান্তি দুঃখিত হইয়া কহিল, আহা বিধবা? তবে এ কাজটা ভাল হয়নি–কিন্তু বিক্রি হল কেন?
দশ বৎসরের খাজনা বাকি ছিল; সুদে-আসলে দেড়-হাজার টাকার নালিশ হয়েছিল।
টাকার কথা শুনিয়া শান্তি মথুরনাথের প্রতি একটু নরম হইয়া পাড়িল। মৃদু হাসিয়া কহিল, তা ম্যানেজারবাবুর বা দোষ কি? অত টাকা কেমন করে ছেড়ে দেন?
সুরেন্দ্রনাথ অন্যমনস্ক হইয়া ভাবিতে লাগিল । শান্তি প্রশ্ন করিল, অত টাকা ছেড়ে দেবে?
দেব না ত কি, অসহায় বিধবাকে বাড়ি-ছাড়া করব? তূমি কি পরামর্শ দাও?
কথাটার ভিতর যতটুকু জ্বালা ছিল, সবটুকু শান্তির গায়ে লাগিল। অপ্রতিভ হইয়া দুঃখিতভাবে সে বলিল, না, বাড়ি-ছাড়া করতে বলি না। আর তোমার টাকা তুমি দান করবে, আমি তাতে বাধা দেব কেন?
সুরেন্দ্র হাসিয়া কহিলেন, সে নয় শান্তি, আমার টাকা কি তোমার নয়? কিন্তু বল দেখি, আমি যখন না থাকব, তখন তুমি–
ও কি কথা–
তুমি–আমি যা ভালবাসি, তা করবে ত?
শান্তির চোখে জল আসিল, কেন না, স্বামীর শারীরিক অবস্থা ভাল নহে, বলিল, ও কথা কেন বল?
বড় ভাল লাগে, তাই বলি। তুমি, আমার কথা, আমার সাধ ইচ্ছা জেনে রাখবে না শান্তি?
শান্তি চক্ষে অঞ্চল দিয়া মাথা নাড়িল।
কিছুক্ষণ পরে সুরেন্দ্র পুনরায় কহিলেন, আমার বড়দিদির
নাম।
শান্তি অঞ্চল সরাইয়া সুরেন্দ্রের মুখপানে চাহিল।
সুরেন্দ্র একখানা কাগজ দেখাইয়া বলিলেন, এই দেখ, আমার বড়দিদির নাম।
কোথায়?
এই দেখ, মাধবী দেবী যাঁর বাড়ি নিলাম হয়েছে।
একমুহূর্তে শান্তি অনেক কথা বুঝিল। কহিল, তাই বুঝি সমস্ত ফিরিয়ে দিতে চাইছ?