আজ তিনদিন হইল–শান্তির স্বামিদর্শন ঘটে নাই। চার দিনের দিন সে স্বামীকে পাইয়া দ্বারে পিঠ দিয়া বলিল, এতদিন ছিলে কোথায়?
বাগানবাড়িতে।
সেখানে কে আছে যে, তিনদিন ধরে পড়েছিলে?
তাইত–
সব কথায় তাইত! আমি সমস্ত শুনেছি–বলিতে বলিতে শান্তি কাঁদিয়া কহিল–আমি কি দোষ করেছি যে, আমাকে পায়ে ঠেলছ?
কৈ তা ত আমি–
আবার কি করে পায়ে ঠেলতে হয়? এর চেয়ে অপমান আমাদের আর কি আছে?
তাইত–তা ওরা সব–
শান্তি যেন সে কথা শুনিতে পাইল না। আরও কাঁদিয়া কহিল, তুমি স্বামী, আমার দেবতা! আমার ইহকাল! আমার পরকাল! আমি কি তোমাকে চিনিনে! আমি ত জানি, আমি তোমার কেউ নই, একদিনের জন্যও তোমার মন পাই না। এ যাতনা তোমাকে বলব কি! পাছে তুমি
লজ্জা পাও, পাছে তোমার ক্লেশ হয়, তাই কোন কথা বলি না।
শান্তি, কেন কাঁদ?
কেন কাঁদি! অন্তর্যামী জানেন। তাও বুঝতে পারি যে তুমি অযত্ন কর না–তোমারও মনে ক্লেশ আছে–তুমি আর কি করবে? তাহার পর চক্ষু মুছিয়া বলিল, আমি আজীবন যাতনা পাই, তাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু তোমার কি কষ্ট যদি জানতে পারি–
সুরেন্দ্রনাথ তাহাকে কাছে টানিয়া লইয়া স্বহস্তে তাহার চক্ষু মুছিয়া সস্নেহে কহিল, তা হলে কি কর, শান্তি?
এ কথার কি আর উত্তর আছে? শান্তি ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল।
বহুক্ষণ পরে শান্তি কহিল, তোমার শরীরও আজকাল ভাল নেই।
আজ কেন, পাঁচ বছর থেকে নেই। যেদিন কলকাতায় গাড়িচাপা পড়েছিলাম, বুকেপিঠে আঘাত পেয়ে একমাস শয্যায় পড়েছিলাম, সে অবধি শরীর ভাল নেই। সে ব্যথা কিছুতেই গেল না, মাঝে মাঝে নিজেই আশ্চর্য হই, কেমন করে বেঁচে আছি।
শান্তি তাড়াতাড়ি স্বামীর বুকে হাত দিয়া বলিল, চল, দেশ ছেড়ে আমরা কলকাতায় যাই, সেখানে ভাল ডাক্তার আছে–
সুরেন্দ্র সহসা প্রফুল্ল হইয়া উঠিল–তাই চল। সেখানে বড়দিদিও আছেন।
শান্তি বলিল, তোমার বড়দিদিকে আমারও বড় দেখতে ইচ্ছে করে, তাঁকে আনবে ত?
আনব বৈ কি! তাহার পর ঈষৎ ভাবিয়া বলিল, নিশ্চয় আসবেন, আমি মরে যাচ্ছি শুনলে–
শান্তি তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল–তোমার পায়ে পড়ি, আর ওসব বলো না।
আহা, তিনি যদি আসেন ত আমার কোনো দুঃখই থাকে না।
অভিমানে শান্তির বুক পুড়িয়া গেল। এইমাত্র সে বলিয়াছিল, স্বামীর সে কেহ নহে। সুরেন্দ্র কিন্তু অত বুঝিল না। অত দেখিল না, যাহা বলিতেছিল, তাহাতে বড় আনন্দ হয়, কহিল, তুমি নিজে গিয়ে বড়দিদিকে ডেকে এনো, কেমন? শান্তি মাথা নাড়িয়া সম্মতি দিল।
তিনি এলে দেখতে পাবে,
আমার কোন কষ্ট থাকবে না।
শান্তির চক্ষু ফাটিয়া জল আসিতে লাগিল।
পরদিন সে দাসীকে দিয়া মথুরবাবুকে সংবাদ প্রেরণ করিল যে, বাগানবাটীতে যাহাকে আনা হইয়াছে, এখনি তাহাকে তাড়াইয়া না দিলে, তাহাকে আর ম্যানেজারের কাজ করিতে হইবে না। স্বামীকে শাসাইয়া বলিল, আর যাই হোক, তুমি বাড়ির বার হলে আমি মাথাখুঁড়ে রক্তগঙ্গা হয়ে মরব।
তাইত, ওঁরা কিন্তু–
আমি ‘কিন্তু’র ব্যবস্থা করছি। বলিয়া শান্তি দাসীকে পুনর্বার ডাকিয়া হুকুম দিয়া দিল–দারোয়ানকে বলে দে, যেন ঐ হতভাগারা আমার বাড়িতে না ঢুকতে পায়!
আর সুবিধা নাই দেখিয়া মথুরবাবু এলোকেশীকে বিদায় করিয়া দিলেন। ইয়ারদলও ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। তাহার পর তিনি চুটাইয়া জমিদারি দেখিতে মন দিলেন।
সুরেন্দ্রনাথের সম্প্রতি কলিকাতায় যাওয়া হইল না, বুকের ব্যথাটা আপাততঃ কিছু কম বোধ হইতেছে। শান্তিরও কলিকাতা যাইতে তেমন উৎসাহ নাই। এখানে থাকিয়া যতখানি সম্ভব, সে স্বামীসেবার আয়োজন করিতে লাগিল। কলিকাতা হইতে একজন বিজ্ঞ ডাক্তার আনাইয়া দেখাইল। বিজ্ঞ চিকিৎসক সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া একটা ঔষধের ব্যবস্থা করিলেন এবং বিশেষ করিয়া সতর্ক করিয়া দিলেন যে, বক্ষের অবস্থা যেমন আছে, তাহাতে শারীরিক ও মানসিক কোনরূপ পরিশ্রমই সঙ্গত নহে।
অবসর বুঝিয়া ম্যানেজারবাবু যেরূপ কাজ দেখিতেছিলেন, তাহাতে গ্রামে গ্রামে দ্বিগুণ হাহাকার উঠিল। শান্তি মাঝে মাঝে শুনিতে পাইত, কিন্তু স্বামীকে জানাইতে সাহস করিত না।
বড়দিদি – ০৮
অষ্টম পরিচ্ছেদ
কলিকাতার বাটীতে ব্রজবাবুর স্থানে শিবচন্দ্র এখন কর্তা। মাধবীর পরিবর্তে নূতন বধূ এখন গৃহিণী। মাধবী এখনও এখানে আছে। তাই শিবচন্দ্র স্নেহ-যত্ন করে, কিন্তু মাধবীর এখানে থাকিতে মন নাই। বাড়ির দাস-দাসী, সরকার-গোমস্তা এখনো ‘বড়দিদি’ বলে, কিন্তু সবাই বুঝে যে, আর একজনের হাতে এখন সিন্দুকের চাবি পড়িয়াছে। তাই বলিয়া শিবচন্দ্রের স্ত্রী যে মাধবীকে অবজ্ঞা বা অমর্যাদা করে তাহা নহে, কিন্তু সে এমন ভাবটি দেখাইয়া যায়, যাহাতে মাধবী বেশ বুঝিতে পারে যে, এই নূতন স্ত্রীলোকটির অনুমতি পরামর্শ ব্যতীত সব কাজ করা এখন আর তাহার মানায় না।
তখন বাপের আমল ছিল, এখন ভাইয়ের আমল হইয়াছে। কাজেই একটু প্রভেদ ঘটিয়াছে। আগে আদর ছিল, আবদার ছিল–এখন আদর আছে, কিন্তু আবদার নাই। বাপের আদরে সে সর্বময়ী ছিল, এখন ‘আত্মীয়-কুটুম্বের’ দলে পড়িয়াছে।
এখন যদি কেহ বলেন যে, আমি শিবচন্দ্র কিংবা তাহার স্ত্রীর দোষ দিতেছি, সোজা করিয়া না বলিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া নিন্দা করিতেছি, তাহা হইলে তাঁহারা আমাকে ভুল বুঝিয়াছেন। সংসারে যাহা নিয়ম, যে রীতি-নীতি আজ পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে, আমি তাহারি উল্লেখ করিয়াছি মাত্র। মাধবীর যেন কপাল পুড়িয়াছে, তাহার আপনার বলিবার স্থান নাই, তাই বলিয়া অপরে নিজের দখল ছাড়িবে কেন? স্বামীর দ্রব্যে স্ত্রীর অধিকার, একথা কে না জানে? শিবচন্দ্রের স্ত্রী কি শুধু এ কথা বুঝে না? শিবচন্দ্র নাহয় মাধবীর ভ্রাতা, কিন্তু সে মাধবীর কে? পরের জন্য সে নিজের অধিকার ছাড়িয়া দিবে কেন? মাধবী সব বুঝিতে পারে। বৌ যখন ছোট ছিল, তখন ব্রজবাবু বাঁচিয়া ছিলেন, তখন মাধবীর নিকট প্রমীলাতে ও তাহাতে প্রভেদ ছিল না। এখন কথার অনৈক্য হয়। সে চিরদিন অভিমানিনী, তাই সে
সকলের নীচে। কথা সহিবার ক্ষমতা নাই, তাই সে কথা সহে না। যেখানে তার জোর নাই সেখানে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে তাহার মাথা কাটা যায়। মনে দুঃখ পাইলে নীরবে সহিয়া যায়, –শিবচন্দ্রকে কিছুই বলে না। স্নেহের দোহাই দেওয়া তাহার অভ্যাসের বাহিরে, তাই আত্মীয়তার ধুয়া ধরিয়া অধিকার কায়েম করিতে, তাহার সমস্ত শরীরে মনে ধিক্কার উঠে। সামান্য স্ত্রীলোকের মত ঝগড়া-কলহে তাহার যে কত ঘৃণা তাহা শুধু সে-ই জানে।