নীলাম্বর শয্যার উপর বসিতেই সে নীচে পায়ের কাছে বসিয়া পড়িয়া বলিল, হয় আমাকে ঋণমুক্ত কর, না হয়, আজ তোমার পা ছুঁয়ে দিব্যি করব।
নীলাম্বর বুঝিল, সে সমস্ত শুনিয়াছে, তাই অত্যন্ত ভয় পাইয়া তৎক্ষণাৎ ঝুঁকিয়া পড়িয়া তাহার মুখে হাত চাপা দিয়া তাহাকে জোর করিয়া টানিয়া তুলিয়া পাশে বসাইয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিল, ছি বিরাজ, সামান্যতেই আত্মহারা হ’সনে।
বিরাজ মুখের উপর হইতে তাহার হাতটা সরাইয়া দিয়া বলিল, এতেও মানুষ আত্মহারা না হয়, কিসে হয় বল শুনি।
নীলাম্বর কি জবাব দিবে হঠাৎ খুঁজিয়া পাইল না, চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
বিরাজ বলিল, চুপ করে রইলে কেন? জবাব দাও।
নীলাম্বর মৃদুকন্ঠে বলিল, জবাব দেবার কিছুই নেই বিরাজ, কিন্তু—
বিরাজ বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না, কিন্তুতে হবে না। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে লোকে তোমাকে অপমান করে যাবে, কানে শুনে আমি সহ্য করে থাকব—এ ভরসা মনে ঠাঁই দিও না। হয় তার উপায় কর, না হয় আমি আত্মঘাতী হব।
নীলাম্বর ভয়ে ভয়ে কহিল, একদিনেই কি উপায় করব বিরাজ?
বেশ, দুদিন পরে কি উপায় করবে, তাই আমাকে বুঝিয়ে বল।
নীলাম্বর পুনরায় মৌন হইয়া রহিল।
বিরাজ বলিল, একটা অসম্ভব আশা করে নিজেকে ভুল বুঝিয়ো না—আমার সর্বনাশ ক’রো না! যত দিন যাবে ততই বেশী জড়িয়ে পড়বে, দোহাই তোমার, আমি ভিক্ষে চাইচি—তোমার দুটি পায়ে ধরছি, এই বেলা যা হয় একটা পথ কর।—বলিতে বলিতে তাহার অশ্রুভারে কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল। ভুলু মুখুয্যের কথাগুলো তাহার বুকের ভিতরে শূল হানিতে লাগিল।
নীলাম্বর হাত দিয়া তাহার চোখ মুছাইয়া দিয়া ধীরে ধীরে বলিল, অধীর হলে কি হবে বিরাজ? একটা বছর যদি ষোল আনা ফসল পাই, বার আনা বিষয় উদ্ধার করে নিতে পারব। কিন্তু বিক্রি করে ফেললে আর ত হবে না সেটা ভেবে দেখ!
বিরাজ আর্দ্রস্বরে বলিল, দেখচি; আসচে বছরেই যে ষোল আনা ফসল পাবে, তারই বা ঠিকানা কি? তার ওপর সুদ আছে, লোকের গঞ্জনা আছে। আমি সব দুঃখ সইতে পারি, কিন্তু তোমার অপমান ত সইতে পারিনে।
নীলাম্বর নিজে তাহা বেশ জানিত, তাই কথা কহিতে পারিল না।
বিরাজ পুনরায় কহিল, শুধু এই কি আমার সমস্ত দুঃখ? দিবারাত্রি ভেবে ভেবে তুমি আমার চোখের সামনে শুকিয়ে উঠচ, এমন সোনার মূর্তি কালি হয়ে যাচ্চে। আচ্ছা, আমার গাঁ ছুয়ে তুমিই বল, এও সহ্য করবার ক্ষমতা কি আমার আছে? আর কতদিন যোগীনের পড়ার খরচ যোগাতে হবে?
আরও একটা বছর। তা হলেই সে ডাক্তার হতে পারবে।
বিরাজ একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, পুঁটিকে মানুষ করেচি—সে আমার রাজরাণী হ’ক, কিন্তু সে হতে আমার এত দুঃখ ঘটবে জানলে, ছোটবেলায় তাকে নদীতে ভাসিয়ে দিতুম। এমন করে নিজের মাথায় বাজ হানতুম না। হা ভগবান! বড়লোক তারা, কোন কষ্ট, কোন অভাব নেই, তবুও জোঁকের মত আমার রক্ত শুষে নিতে তাদের এতটুকুও দয়া-মায়া হচ্চে না! —বলিয়া একটা সুগভীর নিশ্বাস ফেলিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। বহুক্ষণ নিঃশব্দে কাটিবার পরে বিরাজ মুখ তুলিয়া আস্তে আস্তে বলিল, চারিদিকে অভাব, চারিদিকে আকাল, গরীব-দুঃখীরা ত এরই মধ্যে কেউ উপোস, কেউ একবেলা খেতে শুরু করেচে, এমন দুঃসময়েও আমরা পরের ছেলে মানুষ করব কেন? পুঁটির শ্বশুরের অভাব নেই, সে বড়লোক; সে যদি নিজের ছেলেকে না পড়াতে পারে, আমরা পড়াব কেন? যা হয়েচে তা হয়েচে, তুমি আর ধার করতে পাবে না।
নীলাম্বর অতিকষ্টে শুষ্কহাসি ওষ্ঠপ্রান্তে টানিয়া আনিয়া বলিল, সব বুঝি বিরাজ, কিন্তু শালগ্রাম সুমুখে রেখে শপথ করেচি যে! তার কি হবে?
বিরাজ তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, কিচ্ছু হবে না। শালগ্রাম যদি সত্যিকারের দেবতা হন, তিনি আমার কষ্ট বুঝবেন। আর আমি ত তোমারই অর্ধেক, যদি কিছু এতে পাপ হয়, আমি আমার নিজের মাথায় নিয়ে জন্ম জন্ম নরকে ডুবে থাকব; তোমার কিছু ভয় নেই—তুমি আর ঋণ ক’রো না।
নীলাম্বর কাতরদৃষ্টিতে একটিবার মাত্র স্ত্রীর মুখের পানে চাহিয়া পরক্ষণেই নিরুপায়ের মত মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। ধর্মপ্রাণ স্বামীর অন্তরের নিদারুণ দুঃখের লেশমাত্রও তাহার অগোচর ছিল না। কিন্তু সে আর সহিতে পারিতেছিল না। যথার্থই স্বামী তাহার সর্বস্ব ছিল। সেই স্বামীর অহর্নিশি চিন্তাক্লিষ্ট শুষ্ক অবসন্ন মুখের পানে চাহিয়া তাহার বুক ফাটিতেছিল। এতক্ষণ কোনমতে সে কান্না চাপিয়া কথা কহিতেছিল, আর পারিল না। সবেগে স্বামীর বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।
নীলাম্বর তাহার দক্ষিণ হস্ত বিরাজের মাথার উপরে রাখিয়া নির্বাক্ নিশ্চল হইয়া বসিয়া রহিল। বহুক্ষণ কান্নার পরে তাহার দুঃখের অসহ তীব্রতা মন্দীভূত হইয়া আসিলে সে তেমনই মুখ লুকাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ছেলেবেলা থেকে যতদূর আমার মনে পড়ে, কোনদিন তোমার মুখ শুক্নো দেখিনি, কোন দিন তোমার মুখ ভার করতে দেখিনি; এখন তোমার পানে চাইলেই আমার বুকের মধ্যে রাবণের চিতা জ্বলতে থাকে—তুমি নিজের পানে না চাও, আমার দিকে একবার চেয়ে দেখ! সত্যই কি শেষকালে আমাকে পথের ভিখারিণী করবে? সে কি তুমিই সইতে পারবে?
নীলাম্বর তথাপি উত্তর দিতে পারিল না, অন্যমনস্কের মত তাহার চুলগুলি লইয়া ধীরে ধীরে নাড়িতে লাগিল। এমনি সময়ে দ্বারের বাহিরে পুরানো ঝি সুন্দরী ডাকিয়া বলিল, বৌমা, উনুন জ্বেলে দেব কি?